ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন

বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে কৌশলী আ'লীগ

দুই সিটির সিংহভাগ ওয়ার্ডে আ'লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় সব ওয়ার্ডেই নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যাপারে দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে

প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ঢাকার দুই সিটিতে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী দমনে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হলেও তা মূলত দলীয় হাইকমান্ডই স্বেচ্ছায় জিইয়ে রেখেছে। এর নেপথ্যে কৌশলগত ভিন্ন কারণও রয়েছে। দলের নীতি-নির্ধারকরা বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও ভোটের মাঠে প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত ডজনখানেক বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ভোটের মাঠে পর্যবেক্ষকরাও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা জানান, গত টার্মে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ছড়াছড়ি নিয়ে আওয়ামী লীগকে চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে। এ কারণে এবার কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন দেওয়ার আগে প্রার্থীদের সবাইকে গণভবনে ডেকে তাদের কাছ থেকে প্রত্যাহারপত্রে সই নিয়ে রাখা হয়। যাতে কেউ দলীয় সমর্থন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার চেষ্টা করলে তার সই করা মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়ে তাকে ভোটের মাঠ থেকে সহজেই সরিয়ে দেওয়া যায়। অথচ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থন বঞ্চিত স্বল্পসংখ্যক প্রার্থী স্বেচ্ছায় রিটার্নিং অফিসারের কাছে তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন। বাকি বিপুলসংখ্যক প্রার্থী বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। তবে এরপরও দলের পক্ষ থেকে ওইসব প্রার্থীদের আগাম সই করা প্রত্যাহারপত্র রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিল করা হয়নি। যদিও পরবর্তীতে দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে তাদের ভোটের মাঠ থেকে সরে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার কথা শোনা গেছে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী এ প্রতিবেদককে জানান, ভোটারদের সহানুভূতিসহ কৌশলগত নানা সুবিধা পাওয়ার জন্য বিদ্রোহী অনেকেই নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ব্যাপারে দলীয় চাপ দেওয়ার কথা বলে বেড়ালেও বাস্তবে তা ঠিক নয়। দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে বিচ্ছিন্নভাবে দু'একজন নেতা বিদ্রোহী প্রার্থীকে সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন- এটি সত্য। তবে দলীয়ভাবে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের হাইকমান্ডও তাদের কোনো চাপ দেয়নি। ঢাকা-৯ আসনের এলাকাভুক্ত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডের একজন বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী জানান, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির একজন নেতা দলীয় সভানেত্রীর কথা বলে তাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তার (দলীয় সভানেত্রী) কাছে দলীয় সব কাউন্সিলর প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদনপত্র সই করা আছে। তিনি এমনটি চাইলে সে প্রত্যাহারপত্রই কমিশনে পাঠিয়ে দিতে পারতেন। যেহেতু তিনি তা করেননি, তাই তিনি ধরেই নিয়েছেন, তার নির্বাচন করার ব্যাপারে দলীয় সভানেত্রীর কোনো আপত্তি নেই। ওই প্রার্থী জানান, তিনি তার প্রচারণার পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওয়ামী দলীয় মেয়রপ্রার্থী ফজলে নূর তাপসের পক্ষে নৌকা মার্কায় ভোট চাইছেন। তার পোস্টার-লিফলেট বিলি করছেন। তাকে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার জন্য দলীয় হাইকমান্ড চাপ দিলে তিনি এসব করতে পারতেন না। বিশেষ করে দলীয় মেয়রের পক্ষে প্রচারণা চালানো তার পক্ষে অসম্ভব হতো। এদিকে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মুন্সী কামরুজ্জামান জানান, গত টার্মে দলীয় সমর্থন পেয়ে তিনি নির্বাচন করেছেন এবং বিপুল ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। এবার দল তাকে সমর্থন দেয়নি। কিন্তু দলের উচ্চপর্যায় থেকে তাকে নির্বাচন করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তিনিও তার প্রচারণার পাশাপাশি দলীয় মেয়রপ্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। এ ব্যাপারে তিনিও কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বাধা পাননি। দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক সাগর আহমেদ। তিনি বলেন, 'দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সমর্থন নিয়েই নির্বাচন করছি। আমার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য দল থেকে কেউ কিছু বলেনি।' ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হিসেবে লড়ছেন- এমন অন্তত ডজন দেড়েক প্রার্থী জানান, দল থেকে তাদের সমর্থন দেওয়া হয়নি সত্য। কিন্তু স্থানীয় এমপি ছাড়াও দলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মৌখিক অনুমিত দিয়েছেন। দুই সিটির সিংহভাগ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় সব ওয়ার্ডেই নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যাপারে দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও দাবি করেন তারা। যদিও এ বিষয়টির সত্যতা দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা কেউ সরাসরি স্বীকার করেননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের প্রথম সারির একাধিক নেতা জানান, কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও বেশকিছু বিতর্কিত নেতা কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে দলীয় সমর্থন পাওয়ায় দলীয় হাইকমান্ড বিব্রত। তাই বিদ্রোহী প্রার্থীদের সরাসরি প্রশ্রয় দেওয়া না হলেও পরোক্ষভাবে তাদের ভোটের মাঠে লড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে দলের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের অপর একটি সূত্র জানায়, দলের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের কাউকে তারা প্রশ্রয় না দিলেও তাদেরকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো টার্গেট নেই। তার কারণ ব্যাখ্যা করে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি শেষপর্যন্ত ইভিএম-এ নির্বাচন মেনে নেবে কিনা তা নিয়ে তাদের যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এ পদ্ধতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না- এমন অযুহাত তুলে তারা যে কোনো মুহূর্তে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতে পারে এ আশঙ্কাও প্রকট। এ অবস্থায় তাদের বাইরে মাঠে একাধিক প্রার্থী না থাকলে ভোটের উৎসবের আমেজ ফিঁকে হয়ে পড়তে পারে। যা এই মুহূর্তে দল কোনোভাবেই চাইছে না। এছাড়া ঢাকার দুই সিটির বেশিরভাগ ওয়ার্ডের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের পেছনে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো প্রভাবশালী নেতার ইন্ধন রয়েছে। তাই এসব বিদ্রোহী প্রার্থীদের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে ওইসব নেতারা ক্ষুব্ধ হবেন। যার নেতিবাচক প্রভাব দলীয় মেয়রপ্রার্থীর উপর পড়বে। এ অবস্থায় বিদ্রোহী কাউন্সিলরদের ব্যাপারে দলীয় হাইকমান্ড মৌন সম্মতি দিচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা জানান, এ মুহূর্তে দলের মূল টার্গেট প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দুই সিটির মেয়র প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা। তাই বিদ্রোহী কাউন্সিলরদের ব্যাপারে আপত্তি তুলে দলীয় হাইকমান্ড সে সুযোগ নষ্ট করতে চাইছে না। বরং দল সমর্থিত প্রার্থীর বাইরে বিদ্রোহী প্রার্থীরাও দলীয় মেয়রের জন্য যেভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন এটি তারা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এদিকে ভোটের মাঠের পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মূলত নির্বাচনকে উৎসবমুখর ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতেই দলের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কেননা দলের বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকলে দলীয় সমর্থন পাওয়া প্রার্থীরা অনেকেই প্রচার-প্রচারণার মাঠে নিষ্ক্রিয় থাকতেন। এতে ভোটের আমেজ হারাত। এছাড়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা মাঠে থাকায় বিএনপি দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীরা কিছুটা হলেও মাঠে নামতে সাহস পেয়েছে। যা নির্বাচনকে উৎসবমুখর করে তুলেছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, ঢাকার দুই সিটিতে কাউন্সিলর পদে যেসব নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন, দল থেকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দেওয়া না হলে তাদের প্রায় সবারই অনেক আগেই ভোটের মাঠ ছেড়ে যাওয়ার কথা। কেননা এদের বড় একটি অংশের বিরুদ্ধে দখলবাজি, মাদক ব্যবসা, জুয়া ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, 'বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। দলের অন্যদের সঙ্গে কথা বলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।' তবে ঠিক কবে এবং কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা স্পষ্ট করে বলেননি তিনি। প্রসঙ্গত, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১২৯ ওয়ার্ডের মধ্যে ৭৭টিতেই আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের স্বদলীয় 'বিদ্রোহী' প্রার্থীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এসব ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ১১১ জন। এ ছাড়া ৯ জন বর্তমান কাউন্সিলর বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন। এরমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ৪২টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন ৭২ জন। আর ঢাকা উত্তর সিটির ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৫টিতে ৩৯ জন বিদ্রোহী প্রার্থী জোরেশোরে প্রচারণা চালাচ্ছেন। দলীয় হুঁশিয়ারি তারা থোড়াই কেয়ার করছেন। অথচ এসব বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনেকেই থানা কিংবা ওয়ার্ড কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। আবার কেউবা মহানগর বা কেন্দ্রিয় কমিটির নেতা।