বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মানবপাচার ইস্যুতে চাপে সরকার

যাযাদি ডেস্ক
  ২৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
সমুদ্রপথে অভিবাসন প্রত্যাশীরা -ফাইল ছবি

দেশে মানব পাচার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। এমন ঘটনা পুরোপুরি থামাতে না পারা এবং মানব পাচার-সংক্রান্ত মামলাগুলোর জট ছাড়াতে না পারায় আন্তর্জাতিক চাপেও রয়েছে দেশ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচার-বিষয়ক প্রতিবেদনে আরও অবনমনের শঙ্কায় রয়েছে সরকার। মানব পাচার বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, দেশের তিন পাশেই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত থাকায় বেশিরভাগ মানব পাচারের গন্তব্য হয়ে থাকে ওই দেশের বিভিন্ন শহর। আর এর শিকার হচ্ছেন মূলত গরিব ও অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত নারীরাই। ভালো কাজের প্রলোভনে পড়ে সীমান্ত অতিক্রমের পরই তারা বুঝতে পারেন পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছেন তারা। সরকারি হিসাবে, দেশের ১৭টি জেলা থেকে প্রতিবছর ভারতে অনেক নারী পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী পাচার হয় যশোর, নড়াইল ও খুলনা থেকে। বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা সত্ত্বেও পাচারকারীদের ঠেকাতে পারছে না সরকার। এ ছাড়াও সাগরপথে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া নিয়ে যাওয়ার নামে মানব পাচারের ঘটনাও ঘটে থাকে। অন্যদিকে, উন্নত জীবন ও ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে মানব পাচারের ঘটনাতেও মাঝেমধ্যেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে বাংলাদেশ। এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা বিভিন্ন দেশের আদালতে দন্ডিত হয়ে বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে জেল-জরিমানার মুখোমুখি হলে কূটনৈতিক চেষ্টায় তাদের ছাড়িয়ে দেশে ফেরার উদ্যোগ নেয় বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো। তবে এমন ঘটনাগুলো পুরোপুরি রুখে দেয়ার মতো সক্ষমতা পুরোপুরি অর্জনে সক্ষম হয়নি বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র এসব তথ্য স্বীকার করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে দুই বছরে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার নারী ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলাদেশে আসার জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে সরকার ফেরত আনতে পেরেছে মাত্র এক হাজার ৭৪৪ জনকে। আইন-সংক্রান্ত জটিলতায় তাদের সবাইকে এখনো ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। মানব পাচারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে উলেস্নখ করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, 'মানব পাচারের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হন নারীরা। অনৈতিক কাজের জন্য এসব নারীদের বিভিন্ন কৌশলে নিয়ে গিয়ে ভারতে বিক্রি করে দেয়া হয়।' তিনি বলেন, 'আমরা যা আবেদন পেয়েছি, এর ৯০ শতাংশের বেশি নারী বিভিন্ন পতিতালয়ে অবস্থান করছিল। উদ্ধার করার পর তারা বিভিন্ন এনজিও বা অন্য কোনো জায়গায় রয়েছে।' তিনি বলেন, 'আমরা ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি, যারা আবেদন করেছিল, তাদের মধ্যে দুই হাজার ৫০০ জনের মতো নিজেদের ব্যবস্থায় বা অন্য কারও সহায়তায় বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন। আর আমাদের হিসাব অনুযায়ী, পাঁচ হাজারের মতো আবেদন এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।' ওই কর্মকর্তার মতে, মানব পাচার অপরাধটি জটিল; কারণ, এর একটি বড় অংশ দেশের বাইরে সংগঠিত হয়। সেখানে দেশের আইন কাজে আসে না। যুক্তরাষ্ট্রের টিআইপি রিপোর্ট এদিকে এই সমস্যা নিরসন করতে না পারায় গত তিন বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচার (ট্রাফিকিং ইন পার্সন) প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। এর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অত্যাধিক অভিবাসন ব্যয়, অপ্রতুল মামলা, যে মামলা হয় সেটির বিচার না হওয়া, বিচার হলেও শাস্তি না হওয়া প্রভৃতি। ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ আইন করা হলেও এর অধীনে মামলার জন্য পৃথক ট্রাইবু্যনাল গত আট বছরেও তৈরি করতে পারেনি সরকার। এই প্রেক্ষাপটে এ বছর অবস্থানের উন্নতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রাখছে সরকার। কারণ, গত তিন বছর ধরে নজরদারির তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এতদিন দ্বিতীয় ধাপে থাকার পর এ বছর আরও অবনমন হয়ে তৃতীয় ধাপে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় এবং সঙ্গত কারণে রাজনৈতিক। তারা দাবি করেন, ভারতসহ অনেক দেশের মানব পাচার অপরাধের অবস্থা বাংলাদেশের থেকে খারাপ হলেও তারা অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে রয়েছে, যেটি হওয়ার কথা নয়। তবে তারা স্বীকার করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনের কারণেই নয়, নিজেদের প্রয়োজনেই মানব পাচার পরিস্থিতির উন্নতির প্রয়োজন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মানব পাচারের ঘটনায় ৬৪৪টি মামলা হয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে চারটি মামলা, ১১ জনের যাবজ্জীবন ও তিনজনের অন্যান্য মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। ২০১৮ সালে মোট মামলা হয়েছে ৫৪৭টি, ৩৪টি নিষ্পত্তি হয়েছে। সাতজনের যাবজ্জীবন এবং একজনের অন্য মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। ২০১৮ সালে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ছিল ৩,৮৫৩টি। এক বছর পরে সেটি দাঁড়ায় ৪,৪৪০ টিতে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'মানব পাচার মামলা নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশে পৃথক কোনো ট্রাইবু্যনাল নেই। এই মামলা করা হয় নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবু্যনালে।' বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে প্রচুর মামলা হওয়ার কারণে মানব পাচার মামলাগুলো পেছনে পড়ে যায়। নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগে, যার নেতিবাচক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্টে পড়ে বলে তিনি জানান। বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নগামী হলে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বাণিজ্য ও মানবতা সহায়তা ছাড়া অন্য সব সুবিধার ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। এর ফলে হয়ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রে যে প্রশিক্ষণের জন্য যায়, সেখানে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে হতে পারে।' এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'মানব পাচার মামলার একটি জট আছে। এটি কমানোর জন্য ইতোমধ্যে সরকার ময়মনসিংহ বাদে অন্য সাতটি বিভাগীয় শহরে সাতটি মানব পাচার প্রতিরোধ ট্রাইবু্যনাল গঠনের অনুমতি দিয়েছে।' তিনি বলেন, 'জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সবার অনুমোদন হয়ে গেছে। আশা করছি, আইন মন্ত্রণালয় এ বছরের প্রথম ভাগেই ট্রাইবু্যনালের কাজ শুরু করতে পারবে।' বাংলা ট্রিবিউন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে