শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কমিশনারের নোটবুকে ৫ ওসি!

তানভীর হাসান
  ২৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সেবা প্রার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণ ও ঘুষ গ্রহণসহ সুনির্দিষ্ট নানা অভিযোগে ঢাকা মহানগরীর পাঁচ থানার ওসিকে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করার পাশাপাশি তাদেরকে 'নোটবুকে' রেখেছেন ডিএমপি কমিশনার। এছাড়াও ৫০ থানার ওসির চার মাসের আমলনামা তৈরি করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে সংশোধনের জন্য এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে। ডিএমপির উচ্চপর্যায়ে একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ডিএমপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গত চার মাসে থানাগুলোতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ মামলা বা জিডি হয়েছে কমিশনারের নির্দেশে সেসব মামলা-জিডি ডিএমপি সদর দফতর থেকে মনিটরিং করা হয়েছে। প্রতিটি বাদীর সঙ্গে কথা বলেছেন ডিএমপি সদর দপ্তরের বিশেষ টিমের সদস্যরা। তাদের কাছে পুলিশের ঘুষ দাবি, দুর্ব্যবহার কিংবা মামলা নিতে হয়রানির কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়। ডিএমপি কমিশনারের বিশেষ সহকারী নেতৃত্বে ৫-৬ জনের একটি টিম এ নিয়ে কাজ করেন। এছাড়া ডিএমপি সদর দফতরের অতিরিক্ত কমিশনার এবং যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তাও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ শুনেন। যেসব থানার পুলিশে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর তাদের বিষয়টি ডিএমপি কমিশনারকে অবগত করেন। সম্প্রতি ওইসব কর্মকর্তাদের সতর্ক করেন কমিশনার।

তবে যেসব ওসির নাম কমিশনারের নোটবুকে উঠেছে এবং যাদের সতর্ক করা হয়েছে তাদের নাম ডিএমপি সদর দফতর জানাতে চায়নি। এর যুক্তি হিসেবে তারা জানায়, যেহেতু তাদের সতর্ক করা হয়েছে তাই তাদের সংশোধন হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তাদের নাম প্রকাশ হয়ে গেলে তারা চাপে পড়ে যাবে।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, চার মাসে প্রায় দেড় হাজার মামলার বাদী সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। ডিএমপির ৫০ থানায় দিনে অন্তত ৫০০ জিডি হয়। এসবের মধ্য থেকে গুরুত্ব বুঝে প্রতিদিন অন্তত ১০০ জিডির তথ্য নেয়া হয়েছে। থানাপ্রতি দিনে অন্তত দুইজন জিডিকারীর সঙ্গে কথা হয়েছে। ওইসব মামলা বা জিডির বাদীর কাছ থেকেই বেরিয়ে এসেছে, কোন ওসি কার কার কাছ থেকে কত টাকা ঘুষ নিয়েছেন। কার সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন।

সূত্রটি জানায়, ডিএমপি সদর দফতর থেকে জিডি বা মামলার বাদীর সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি জানতে পেরে কোনো কোনো থানা জিডির বা মামলার কপিতে বাদী নম্বর ইচ্ছে করে 'ভুল' লেখেন। পুরো নম্বর ঠিক থাকলেও একটি বা দুটি জিজিট ভুল লেখা হয়। যাতে সনদর দফতর থেকে ওই নম্বরে ফোন করা হলে প্রকৃত বাদীকে পাওয়া না যায়। এই বিষয়টিও ধরা পড়েছে। পুলিশ সদর দফতরে ডেকে এনে ওইসব পুলিশ কর্মকর্তাদেরও সতর্ক করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, থানায় দুই ধরনের মামলা হয়। এক ধরনের মামলায় পুলিশ বাদী হয়। পাবলিক বাদী হয়ে অপর ধরনের মামলা করে। পুলিশ বাদী হয়ে যেসব মামলা করে সেসব ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন হয়নি। তাই এ ক্ষেত্রে বাদী সঙ্গে কথা বলা হয়নি। তবে পাবলিক বাদী হয়ে যেসব মামলা করেছে সেসব ক্ষেত্রে প্রত্যেকের সঙ্গে ডিএমপি সদর দফতরের টিম কথা বলেছে।

ডিএমপির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, জরুরি সমস্যা নিয়ে অনেক সেবাপ্রার্থী থানায় আসেন। কখনও কখনও ডিউটি অফিসাররা ওইসব সমস্যার সমাধান দিতে পারেন না। তাই সংশ্লিষ্ট ডিউটি অফিসার থানার ওসির স্মরণাপন্ন হয়। তখন ওসি বলেন, 'ওই লোককে একটু বসতে বলেন। আমি থানায় আসছি।' কিন্তু ওই লোক তিন ঘণ্টা থানায় বসে থাকলেও ওসি থানায় আসেননি। এ কারণে থানায় আসা লোকটি ভোগান্তিতে পড়েন। তবে ওইসব ডিউটি অফিসারকে ৫০০-১০০০ টাকা দিয়ে দিলে ভুক্তভোগী লোকটির কাজ হয়ে যায়। তখন আর কষ্ট করে থানায় বসে থাকতে হয় না। তবে গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে এখন এটি হচ্ছে না। জিডির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট থানাগুলোতে এই কাজটি এখনও হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গত সেপ্টেম্বরে ডিএমপি কমিশনার হিসেবে মোহা. শফিকুল ইসলাম যোগদানের পর থেকে প্রতিটি ক্রাইম কনফারেন্স পুলিশের মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধ করছেন। সাম্প্রতিক এক ক্রাইম কনফারেন্সে কমিশনারের বক্তব্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, কোনো সাধারণ মানুষকে যদি এলাকার মাস্তান টাইপের কেউ থাপ্পর দেয় তাহলে আইনগতভাবে তেমন কিছু করার নেই। কিন্তু থাপ্পর খাওয়া লোকটি নিশ্চয়ই অপমান বোধ করেন। অপমান বোধ নিয়ে যদি তিনি থানায় আসেন তাহলে তার সঙ্গে থানার কর্তারা দুই ধরনের ব্যবহার করেন। এক ধরনের অফিসার বলেন, 'থাপ্পর মেরেছে- আমি কী করব? এটার আবার মামলা কী? পারলে আপনি গিয়েও থাপ্পর মেরে আসেন।' ভুক্তভোগীর সঙ্গে আরও খারাপ আচরণ করা হয়। এতে ওই লোকটি থানায় এসে আরও অসম্মান বোধ করেন। পক্ষান্তরে আরেক ধরনের অফিসার থাপ্পর খাওয়া লোককে বসিয়ে বুঝিয়ে বলেন, 'থাপ্পর মারার বিষয়ে আইনে তেমন কিছু করার নেই। আপনি বড় জোর একটি জিডি করে যেতে পারেন। জিডি করতে কোনো টাকা-পয়সা লাগে না। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে।' ভালো ওসিরা ভুক্তভোগীকে সামনে বসিয়ে রেখেই ওই থাপ্পর দেয় মান্তান প্রকৃতির লোককে ধমক দেন। গ্রেপ্তারের ভয় দেখান। এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেন। এতে ভুক্তভোগী খুশি মনে থানা ত্যাগ করতে পারেন।

অপর এক ক্রাইম কনফারেন্সে ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যের উদ্বৃতি দিয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জমিজমার বিরোধ এবং আদালতে মামলা থাকার বিষয়ে পুলিশ তেমন কিছু করতে পারে না। কিন্তু এসব সমস্যা নিয়ে কেউ থানা এলে কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। তাদেরকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে হবে। যতটুকু সম্ভব তাকে সহযোগিতা করতে হবে। এতে তার কাজ না হলেও খুশি হবে। তাকে যদি বলা হয়, 'জমি কেনার সময় তুমি দেখে কেননি। এখন আমি কী করব?' তাহলে পুলিশের প্রতি মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। তিনি বলেন, ক্রাইম কনফারেন্স দেয়া কমিশনারের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটছে। থানায় সেবা প্রার্থী যেসব লোকের সঙ্গে ডিএমপি সদর দফতর থেকে কথা বলা হচ্ছে তাদের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ খুশি। তারা জানান, থানায় গেলে তারা আগের মতো হেনস্থা হচ্ছে না। থানার ওসিরা আগের চেয়ে বেশ আন্তরিকতা নিয়ে তাদের অভিযোগ শুনছেন। জিডির তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তবে ১০ ভাগ লোক এখনও খুশি না। সবাই যাতে খুশি হতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করছে পুলিশ সদর দফতর।

জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ওসিসহ ডিএমপির যেসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের সতর্ক করেছি। পাশাপাশি বিশেষ টিমের মাধ্যমে তাদের মনিটরিং করা হচ্ছে। আগামী এক মাস পর আবারও সংশ্লিষ্ট ওসিদের নিয়ে বসব। এই সময়ের মধ্যে তারা যদি সংশোধন না হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<86177 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1