ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন

সবার দৃষ্টি এখন ইভিএমে

প্রকাশ | ৩০ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন উপলক্ষে ইসি বিভিন্ন স্থানে ইভিএম প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ছবিটি রাজধানীর একটি স্কুল থেকে তোলা -ফাইল ছবি
সাখাওয়াত হোসেন নানা বিতর্কের পরও নির্বাচন কমিশন দেশে প্রথমবারের মতো কোনো ভোটে পূর্ণাঙ্গ ইভিএম ব্যবহারের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ায় ভোটারসহ সর্বস্তরের মানুষের দৃষ্টি এখন সেদিকে। পাশাপাশি এ মেশিন পরিচালনাকারী প্রিজাইডিং অফিসারসহ নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তারা ভোটের মাঠে কী ভূমিকা নেবেন তা জানতে মুখিয়ে আছে সবাই। ইভিএমের ভোটে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখতে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। এ ছাড়া দেশি পর্যবেক্ষকের সংখ্যাও এক সহস্রের কম নয়। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ইভিএমে ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো পক্ষকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অপচেষ্টা চালালে সহজেই তা সবার দৃষ্টিতে ধরা পড়বে। এ পরিস্থিতি সাধারণ ভোটাররা ক্ষুব্ধ হয়ে তা প্রতিহত করবে। এমনকি এ নিয়ে ভোট বাতিলে আন্দোলন গড়ে ওঠারও ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনের দাবি, ইভিএম মেশিনে ডিজিটাল কারচুপির কোনো সুযোগই নেই। এরপরও প্রিজাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট কেউ এ ধরনের অপতৎপরতার চেষ্টা চালালে তা তাৎক্ষণিক টের পাওয়া যাবে। সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও হুঁশিয়ার করা হয়েছে বলে দাবি করেন ইসির শীর্ষ কর্মকর্তারা। এদিকে জোরালো আপত্তি তুলেও ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিলে ব্যর্থ হয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটের মাঠে বড় ধরনের কারচুপির শঙ্কা তাদের রয়েই গেছে। দলটি বলছে, এই ইভিএম নীরব, নির্দেশিত, নিঃশব্দ, স্বয়ংক্রিয় ভোট চুরির প্রকল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। ইভিএমের প্রোগ্রামিংয়ের ওপর ফলাফল নির্ভর করছে। ভোটের ফলাফল নিয়ন্ত্রিত হবে প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে। ইসি ইভিএমের পক্ষে যেসব যুক্তি দিয়েছে, এর কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপির শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগ একেকবার একেক কৌশলে ভোট জালিয়াতি করেছে। যা পরবর্তীতে ফাঁস হয়ে গেছে। তাই এবার তারা ভিন্ন কৌশল এঁটেছে। ইভিএম মেশিনে ডিজিটাল কারচুপি হলে তা ধরার ক্ষমতা কারও নেই। এমনকি তা প্রমাণেরও কোনো সুযোগ থাকছে না। তবে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারলে সরকার যে অপকৌশলই প্রয়োগ করুক না কেন ভোট জালিয়াতি করতে পারবে না বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন তারা। এদিকে বিএনপি সূত্র জানায়, ইভিএমে ভোট কারচুপি ঠেকানোর বিষয়টি তারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। তাই প্রতিটি ভোটকক্ষে পোলিং এজেন্ট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে স্থানীয় কাউন্সিলর প্রার্থীর পাশাপাশি দলের তৃণমূল নেতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে কোনো ধরনের জালিয়াতির চেষ্টা চালানো হলে তাৎক্ষণিক যাতে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় তা নিশ্চিত করারও তাগিদ দিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীর পাশাপাশি দল সমর্থিত ভোটাররা যাতে ভোট শুরুর পরপরই কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন সে জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করেন, ভোটাররা উপস্থিত থেকে নিজ নিজ ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে ইভিএমে কারচুপি হয়েছে কিনা তা কিছুটা হলেও টের পাওয়া যাবে। যা তাদের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সক্ষম না হলেও ইভিএম ভোটে কারচুপির বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে উত্থাপন করা সম্ভব হবে। বিএনপির থিংকট্যাংকরা মনে করেন, ঢাকার দুই সিটিতে পূর্ণাঙ্গ ইভিএম ব্যবহারের পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের সুদূরপ্রসারী ফন্দি রয়েছে। এ নির্বাচনে তারা সুন্দরভাবে উতরে যেতে পারলে আগামী সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে। আর ওই সময় তারা মূল ফয়দা লুটবে। তাই ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ইভিএমের অপব্যবহারে আওয়ামী লীগ যথেষ্ট সতর্ক থাকবে বলে মনে করেন তারা। তবে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা বিএনপির এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সব খাতে ডিজিটাল কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। তাই ভোটের মাঠে ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আগেও ইসি বিভিন্ন নির্বাচনে সীমিত আকারে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করেছে। তাতে কোনো ধরনের কারচুপির অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তাই ইসি ঢাকার দুই সিটিতে পূর্ণাঙ্গ ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলের নীতি-নির্ধারকদের দাবি, ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত ইসির হলেও এ ব্যাপারে তারা পূর্ণ সহযোগিতার চেষ্টা করছে। যাতে এ প্রক্রিয়া সর্ব সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। ইভিএমে স্বচ্ছ ভোটে তাদের কিছু প্রার্থী হেরে গেলেও দলের ইমেজ বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে ইভিএম মেশিন পরিচালনার ক্ষমতা সম্পূর্ণ প্রিজাইডিং অফিসারের হাতে থাকলেও বহিরাগত কেউ যাতে তাকে দিয়ে কোনো ধরনের কারসাজির অপচেষ্টা চালাতে না পারে সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা জানান, ভোটকেন্দ্র দখল করে ডিজিটাল কারচুপি সম্ভব বলে কমিশনের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তারা ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা ছক সাজিয়েছে। রাজনৈতিক ক্যাডার, সশস্ত্র সন্ত্রাসী কিংবা প্রার্থীরা কেউ তাদের সহযোগিদের নিয়ে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে যাতে কোনো মহড়া দিতে না পারে সে ব্যাপারেও তাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিকে ইভিএমে কারসাজির মাধ্যমে বিপুল ভোটে জিতিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিলেও এদের কোনো ভিত্তি নেই বলে জানান গোয়েন্দারা। তাদের ভাষ্য, এরা সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র। তাদের ওপর গোয়েন্দারা নজর রাখছে। ইভিএম নিয়ে সাধারণ মানুষের যে সংশয়-সন্দেহ রয়েছে, প্রতারকচক্র সে সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। ভোটের মাঠে ইভিএমে যাতে কোনো ধরনের জালিয়াতি না হয় সে ব্যাপারে তারা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে বলে জানান ওই গোয়েন্দারা। এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম সারির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ইসু্যটি তারা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। দুই সিটিতে ভোটে জয়লাভের চেয়ে ইভিএমে ভোটারদের বিশ্বস্ততা অর্জনের বিষয়টি তাদের কাছে মুখ্য। এ ব্যাপারে দলীয় সভানেত্রী তাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ওই নেতাদের ভাষ্য, ইভিএমে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভোট হলে ইসির পাশাপাশি ক্ষমতাসীন সরকার এর 'ক্রেডিট' পাবে। এতে দলীয় ইমেজও বাড়বে। তাই ভোটের মাঠে ইভিএম যাতে কোনোভাবে কলঙ্কিত না হয় এ জন্য তারাও ভোটকেন্দ্র পাহারা দেবে বলে জানান তারা। এদিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলেন, ভোটের প্রচারণার মাঠে ছোটখাটো হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও বড় ধরনের কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়নি। বিগত সিটি ও সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-দলীয় প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণা চালানোর তেমন সুযোগ না পেলেও এবার তারা এ ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরপাকড়েরও তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় আশা করা যায়, নির্বাচন শুধু স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুই নয়, তা চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। আর এমনটি ঘটলে দলীয় প্রার্থীর জয়-পরাজয় ছাপিয়ে সর্বমহলে ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে- যোগ করেন পর্যবেক্ষকরা।