বিএনপিতে মাঠকর্মীর খরা!

খালেদা জিয়ার কারাবন্দির দুই বছর পূর্তির দিনে তার মুক্তির দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে নেতাকর্মী সমাগমের নাজুক চিত্রে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে

প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিএনপির দলীয় কর্মসূচিতে কর্মী সংখ্যা ধীরে ধীরে কমলেও এবার তা খরায় রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট ধরে রাখার ব্যর্থতা এবং মেয়র-কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবির পর দলের সভা-সমাবেশসহ স্থানীয় পর্যায়ের সাংগঠনিক কর্মসূচিতে কর্মী উপস্থিতির হার উদ্বেগজনক হারে কমেছে। খালেদা জিয়ার কারাবন্দির দুই বছর পূর্তির দিনে তার মুক্তির দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে নেতাকর্মী সমাগমের নাজুক চিত্রে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মাঠপর্যায়ের নেতারা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীরা গো-হারা হেরে যাওয়ার পর অবস্থা এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাস্তায় কিংবা হলরুমে আয়োজিত দলীয় কোনো কর্মসূচিতে শোরগোল বা হাততালি দেয়ার মতো কর্মী জড়ো করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। দর্শক সারির পেছনের চেয়ারগুলো প্রায়ই ফাঁকা পড়ে থাকছে। কোনো কোনো কর্মসূচিতে কর্মীর চেয়ে নেতার আধিক্য দেখা দিচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ অনেক কর্মী মাঝপথে নেতাদের বক্তব্য থামিয়ে দিয়ে তাদের তোপের মুখে ফেলছেন। কর্মী সংকট নিয়ে খোদ সিনিয়র নেতারাও হতাশায় ভুগছেন বলেও স্বীকার করেন সংশ্লিষ্টরা। তৃণমূল নেতারা জানান, জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবি, ঢাকা সিটি নির্বাচনের পরে দলের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে রাজপথে কঠোর কর্মসূচি না আসায় পুরোপুরি মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন তারা। এ ছাড়া দলীয় চেয়ারপারসনকে কারাগারে রেখে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেলও তার মুক্তির ব্যাপারেও জোরালো কর্মসূচি দেওয়া হয়নি। তাই দলের ওপর আর ভরসা করতে পারছেন না তারা। এ অবস্থায় ঘরের ভেতরে লোক দেখানো কর্মসূচিতে যোগ দিতে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মাঠকর্মীদের আক্ষেপ, এমনিতেই মামলা-হামলায় সব শেষ, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ, সঞ্চিত অর্থও শেষ হওয়ার পথে। এছাড়া রাজনৈতিক মামলার কারণে বছরের বেশিরভাগ সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। এ অবস্থায় দলের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে রাজপথের কঠোর কর্মসূচি জরুরি হলেও অজ্ঞাত কারণে নেতারা তা দিচ্ছেন না। যা তাদের মাঝে সন্দেহ সৃষ্টি করছে। এদিকে তৃণমূল নেতাদের অনেকের অভিযোগ, পকেট কমিটির কারণে যোগ্য ও সক্রিয় কর্মীদের দলে সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। এছাড়া নেতৃত্বেরও পুনর্গঠন নেই। দলীয় কর্মসূচিতেও কর্মীদের প্রস্তাবের প্রতিফলন হচ্ছে না। কর্মসূচিতে সমন্বয়েরও ভয়াবহ ঘাটতি রয়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে অনেক কর্মসূচিতে এখন সিনিয়র নেতারা নিজেরাও যান না। এ ছাড়া কিছু দাম্ভিক নেতা দলীয় কর্মীদের কর্মী না ভেবে কর্মচারী মনে করেন। ফলে কর্মীদের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে দলের প্রথম সারির একাধিক নেতা জানান, সাংগঠনিক হতাশা থেকে দলীয় কর্মীরা অনেকে খ্যাপাটে হয়ে উঠেছে। এ কারণে তারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশ চলাকালে নেতাদের বক্তব্য থামিয়ে দিয়ে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। ফুঁসে ওঠা কর্মীরা বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে নেতাদের অনুপস্থিতি নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন বলে জানান তারা। বিএনপি দলীয় একজন সাবেক সংসদ সদস্য বলেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা দলীয় কার্যালয়ে বসে এবং ঘরোয়া সভা সেমিনারে গরম বক্তৃতা করলেও কর্মসূচিতে মাঠে নামেন না। আর মানববন্ধন কর্মসূচি ডেকে সেখানে জনসভার মতো বক্তৃতা করা নেতাদের নতুন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিডিয়ায় কাভারেজের জন্য কেন্দ্রীয় নেতারা এসব সাজানো কর্মসূচি পালন করছেন। এতে দল চাঙ্গা হচ্ছে না। বরং তৃণমূলে হতাশা বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের আচরণ দেখলেই বোঝা যায়, মাঠের কর্মীরা হয়তো সহসাই চাঙ্গা হবে না। এ জন্য দলকে আরও প্রায় চার বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে ওই সাংসদের যুক্তি- আন্দোলনের মাঠ ফাঁকা থাকলেও নির্বাচন এলে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দীর্ঘলাইন পড়বে। এ সময় তারা নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের জানান দিতে নানা শো-ডাউন করবেন। এতে নেতাদের কাছে কর্মীদের চাহিদা যেমন বাড়বে, তেমনি তারা তৎপরতা দেখাবে। তাই চুপচাপ বসে মোবাইল ফোনে দল চালাচ্ছেন বেশিরভাগ নেতা। তবে বিএনপির নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের দাবি, দলীয় কর্মসূচিতে কর্মী শূন্যতার নেপথ্যে তৃণমূলের হতাশা উলেস্নখযোগ্য কারণ হলেও আরও একাধিক ইসু্য যুক্ত রয়েছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ২৫ হাজার কর্মী কারাবন্দি এবং এর প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক কর্মী বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় ধাওয়ার উপর থাকায় দলীয় কর্মসূচিতে কর্মী সংকট দেখা দিচ্ছে বলে মনে করেন তারা। সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করে বলেন, খুব শিগগিরই অবস্থার পরিবর্তন হবে। রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে কর্মীদের চাঙ্গা করে তাদের হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনা হবে। তবে এর আগে কর্মীদের রাজনৈতিক মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে দল জোরালো পদক্ষেপ নেবে। নেতারা জানান, ঢাকার সিটি নির্বাচনের সময়ে মাঠের নেতাকর্মীদের যেভাবে হয়রানি করা হয়েছে, তাতে তারা অনেকেই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। যে সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য কিছুটা সময় দেওয়া হয়েছে। যথাসময়ে রাজপথে কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে বলে কর্মীদের আশ্বস্ত করেন তারা। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, দলের এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। বিভিন্নভাবে নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। কর্মসূচিতে কর্মীরা যোগ দিলে তাদের বেছে বেছে পুলিশ হেনস্থা করছে। তবে এরপরও কর্মীরা যে হতাশ নন, তা দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের সরব উপস্থিতি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে। এ ছাড়া কর্মীদের আরও জোরালো আন্দোলনের প্রত্যাশা তাদের দৃঢ় মনোবল প্রকাশ পাচ্ছে বলে দাবি করেন নজরুল ইসলাম। যদিও এ ব্যাপারে বিএনপির নির্বাহী কমিটির একাধিক সদস্য ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তারা মনে করেন, পারিপার্শ্বিক নানা পরিস্থিতিতে মাঠকর্মীদের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে গেছে। ঢাকার সিটি ভোটের মাঠে তাদের উপরে যেভাবে হামলা হয়েছে তাতে তারা আবারো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার উপরে কেন্দ্রীয় নেতাদের যেভাবে খোঁজখবর নেয়ার কথা ছিল তা তারা নেননি। যা তাদেরকে আরও আস্থাহীন করে তুলেছে। মাঠের কর্মীদের উজ্জীবিত করতে কর্মিসমাবেশ এবং সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রয়োজন। নেতারা কর্মীদের কাছে পৌঁছতে না পারলে কিছুদিন পরে দলীয় কর্মসূচি পুরোপুরিই কর্মীশূন্য হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের দায়িত্বশীল এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস নেই, কষ্ট আছে। খালেদা জিয়া কারাগারে না থাকলে পার্টি অফিস নেতাকর্মীতে সয়লাব হয়ে যেত। কিন্তু বছর দুয়েক ধরে সেখানে নেতাকর্মীর খরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় রাজপথে কর্মী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে বলে মনে করেন তিনি। ছাত্রদলের এক নেতা বলেন, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক বিপর্যয় হয়েছে। এর উপর যেসব নেতাকর্মী সিটির ভোটের মাঠে সক্রিয় ছিলেন তারা এখন নানাভাবে হয়রানি স্বীকার হচ্ছে। তাদের অনেকে এখন বাড়িতে থাকতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতেও যে নেতাকর্মীরা দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন- এটাই অস্বাভাবিক বিষয়। শনিবার নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশে যোগ দিতে এসে গাজীপুর যুবদলের এক নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিতে সক্রিয় কর্মীর সংকট থাকলেও এখন তা তীব্র রূপ নিয়েছে। সমাবেশে হতাশাজনক উপস্থিতি নেতাকর্মীদের মনোবল আরও ভেঙে দিয়েছে। যুবদল ওই নেতা জানান, সমাবেশস্থল সীমিত জায়গায় হওয়ায় দেরিতে গেলে সেখানে ঠাঁই পাওয়া যাবে কিনা এ আশঙ্কায় তিনি তার কর্মীদের নিয়ে আগেভাগেই নয়াপল্টন এলাকায় উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে দুপুরের পর নেতাকর্মীদের উপস্থিতি দেখে তিনি শুধু হতাশ নন, ভীষণভাবে 'ধাক্কা' খেয়েছেন। এ ধরনের কর্মসূচিতে অতীতে কখনো এত কম নেতাকর্মী জড়ো হতে তিনি দেখেননি বলে জানান।