ভিকারুননিসা-আইডিয়ালেও একাধিক অবৈধ শাখা!

এবার সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে শিক্ষাবোর্ড অবৈধ তালিকার শীর্ষে রাজধানীর আরও প্রতিষ্ঠান ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের নিম্নমাধ্যমিক স্তরের অনুমতি বাতিল

প্রকাশ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
নূর মোহাম্মদ রাজধানী সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় একটি শাখার অনুমোদন রয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটি গুলশান, উত্তরা, মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষাবোর্ডের অনুমোদনবিহীন একাধিক শাখা ক্যাম্পাসে চালাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অনুমোদিত শ্রেণি শাখা রয়েছে মাত্র ২০টি। অথচ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ছয় শতাধিক শ্রেণি শাখা চালাচ্ছে। একই অবস্থা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের। ওই প্রতিষ্ঠানটির বনশ্রী শাখা ও শতাধিক শ্রেণি শাখার অনুমোদন নেই। শুধু এ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, সারাদেশে এভাবে বিপুলসংখ্যক স্কুল-কলেজের অনুমোদনহীন শাখা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে শিক্ষাবোর্ড। প্রথমে শোকজ, জবাব সন্তোষজনক না হলে একপর্যায়ে একাডেমিক ও পাঠদানের স্বীকৃতি বাতিল করা হচ্ছে। শিক্ষাবোর্ড ও অসুন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ধারাবাহিকা কাজের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন-সংক্রান্ত নথি ঘাঁটতে গিয়ে 'কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে আসার মতো অবস্থা'। রাজধানীর নামিদামি অনেক প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্রাঞ্চের অনুমোদন নেই। মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে সেই আবেদন দিয়েই ব্রাঞ্চ খুলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। ভিকারুননিসার মতো স্কুলে মাত্র ২০টি শ্রেণি শাখার অনুমোদন দিয়ে তিনটি শাখায় ২৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্কুল-কলেজের এ রকম ভুঁইফোঁড় শাখার সন্ধান পেয়েছে তারা। এরই অংশ হিসেবে গত ১১ ফেব্রম্নয়ারি চিঠি দিয়েছে ৩৩টি শিক্ষাপ্র্রতিষ্ঠানের নিম্নমাধ্যমিক স্তরের অনুমতি না থাকায় চলতি শিক্ষা বর্ষে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অনলাইনে নিবন্ধন পাসওয়ার্ড বন্ধ করেছে দিয়েছে ঢাকা বোর্ড। একই পরিস্থিতির শিকার হবে একাদশ পর্যায়ের কলেজগুলো। আসন্ন কলেজ পর্যায়ে ভর্তিতে অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বন্ধ করে দেবে শিক্ষাবোর্ড। এ ব্যাপারে ঢাকা শিক্ষাবোর্ড ও আন্তঃশিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক যায়যায়দিনকে বলেন, 'বেআইনিভাবে চালানো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট শাখাকে বলেছি। তারা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করার পর যখনই আমাদের নজরে আসছে তখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। এত বছর কীভাবে চলছে এমন-প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সে ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটছে না। আমরা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা অনুমোদন দিচ্ছি না।' ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের স্কুল ও কলেজ শাখা সূত্রে জানা গেছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি শাখা ১৯৯৬ সালে রামপুরা থানার বনশ্রীতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ শাখাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই চলছে। ২০১৪ সালে ১০তলা একটি ভবন করা হয়েছে সরকারি টাকায়। একই শাখায় বাংলা ভার্সনের পাশাপাশি ইংলিশ ভার্সনেও পাঠদান চলছে। অনুসন্ধান বোর্ডের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এ প্রতিষ্ঠানের বনশ্রী শাখার কোনো অনুমোদন নেই। এছাড়া মতিঝিল মূল ক্যাম্পাসের ১০৫টি শ্রেণি শাখার মধ্যে ৩২টি ও মুগধা শাখার ৫৬টি অতিরিক্ত শ্রেণি শাখার অনুমোদন নেই। প্রতি বছর এসব অবৈধ শাখা ক্যাম্পাস ও শ্রেণি শাখায় শিক্ষার্থী ভর্তি করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালে ভর্তি পরীক্ষার খাতা জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বর্তমানে অধ্যক্ষের এমপিও স্থগিত আছে। এর আগেও একবার তার এমপিও স্থগিত করা হলে উচ্চ আদালতে মামলা করে সরকারি বেতন-ভাতা সচল করেন। গত ১১ ফেব্রম্নয়ারি ভিকারুননিসা প্রতিটি ব্রাঞ্চ ও শ্রেণিভিত্তিক শাখা ও শিক্ষার্থীর তথ্য ১২ ফেব্রম্নয়ারির মধ্যে দিতে চিঠি দিলেও প্রতিষ্ঠানটি গতকাল সোমবার পর্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়নি। এ প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার দিবা ও প্রভাতী শাখার ১০টি করে মাত্র ২০ শ্রেণি শাখার অনুমোদন আছে। বাকিগুলো অবৈধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ২৫ হাজার শিক্ষার্থী পাঠদান করছে। এ হিসাবে অন্তত ৬২৫টি অতিরিক্ত শাখা দরকার। ভর্তি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী একটি শাখা সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে। এর অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করতে হলে মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত শ্রেণি শাখা পরিচালনার অনুমোদন নিতে হবে। এ ব্যাপারে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফওজিয়া যায়যায়দিনকে বলেন, 'বোর্ড শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষার্থী চেয়েছে সেগুলো আমরা মেইলে দিয়েছি।' অনুমোদন না নিয়ে শ্রেণিভিত্তিক শাখা ও শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একই চিত্র রাজধানীর আরেক নামি প্রতিষ্ঠান উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের নিন্মমাধ্যমিক শাখার অনুমোদন ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। রাজধানীতে শিক্ষাবাণিজ্য ধারা শুরু করেছে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে গুলশান-১-এর ২২ নম্বর সড়কে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। পরবর্তীতে শিক্ষাবোর্ডের অনুমোদন নিয়ে একই এলাকার ৩ নম্বর সড়কে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৭ সালের ৪ জুলাই বোর্ডের অনুমতিপত্রে তিনটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। শর্তগুলো হলো-বোর্ডের অনুমতি ছাড়া ঠিকানা পরিবর্তন করা যাবে না, আগামী দুই বছরের মধ্যে নিজস্ব জমি ও ভবনের ব্যবস্থা করতে হবে। কলেজ ভবনের কোনো অংশই অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বোর্ডের তৎকালীন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটি গুলশান থেকে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় স্থানান্তরিত করা হয়। নতুন অনুমোদনে আগের প্রথম দুটি শর্ত বহাল রাখা হয়। কিন্তু এই শর্ত লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে গুলশান, উত্তারা, মিরপুর ও বারিধারায় অবৈধভাবে শাখা ক্যাম্পাস খুলে শিক্ষা বাণিজ্য করছে। এ ব্যাপারে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হামিদা আলী যায়যায়দিনকে বলেন, 'বোর্ডের শোকজের জবাব দেওয়া হয়েছে। বাকি বিষয়গুলো চারজন অধ্যক্ষ আছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। এ ব্যাপারে একটি শাখার অধ্যক্ষ উইং কমান্ডার (অব.) আমজাদ হোসেন বলেন, 'অনেক প্রতিষ্ঠানের একই নামে বিভিন্ন ব্রাঞ্চ চলছে, আমরাও সেভাবে চালিয়েছি। এখন আলাদা অনুমোদন নিতে হবে জানার পর সেভাবেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি।' এত দিন অনুমোদন ছাড়া ব্রাঞ্চ চলল কীভাবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'সবই মূল ব্রাঞ্চের অধীনে চলেছে।' ঢাকা শিক্ষাবোর্ড ও আন্তঃশিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ যায়যায়দিনকে বলেন, 'সারাদেশে কলেজগুলোর অনুমোদন-সংক্রান্ত নথি যাচাই করতে গিয়ে রীতিমতো 'থ' হয়ে গেছি। শুধু প্রতিষ্ঠান আবেদন করেই রাজধানীতে তিনটি ব্রাঞ্চ খুলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। এছাড়া শাখা, শ্রেণি শাখা, কমিটি, অতিরিক্ত ফি আদায়সহ নানা ক্যাটাগরিতে ভাগ করে যাচাই-বাচাই চলছে। যারাই নিয়মের বাইরে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের ধরা হচ্ছে।' মাধ্যমিক পর্যায়ে একই ধরনের অভিযান চলছে। ঢাকা বোর্ডের স্কুল পরিদর্শক মোহাম্মদ আবুল মনছুর ভূঞা গত ১১ ফেব্রম্নয়ারি চিঠি দিয়েছে ৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিম্নমাধ্যমিক স্কুলের অনুমতি না থাকায় চলতি শিক্ষা বর্ষের অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অনলাইনে নিবন্ধন পাস ওয়ার্ড বন্ধ করেছে দিয়েছে ঢাকা বোর্ড।  এ ব্যাপারে স্কুল পরিদর্শক বলেন, কলেজের অনুমোদন নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করলেও নিম্নমাধ্যমিক স্তরের অনুমতি ছাড়াই শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিম্নমাধ্যমিক স্কুলের পাঠদানের অনুমতি না থাকায় নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।