শোক আর গৌরবের অমর একুশে আজ

প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'- অমর একুশের এই গান গেয়ে একুশের প্রথম প্রহর থেকে মানুষের স্রোত মিশে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। গভীর শ্রদ্ধায়, প্রাণের অঞ্জলিতে ভরে ওঠে মিনার প্রাঙ্গণ -যাযাদি
'অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা/সেই থেকে শুরু.../সেই থেকে শুরু দিনবদলের পালা। কঠিন ছন্দে বেঁধেছিলে মন্দিরা/ গুরু গর্জনে জেগেছিল বন্দিরা/ ভেঙে পড়েছিল শত বন্ধন... ভেঙে পড়েছিল/ভেঙে পড়েছিল শত বন্ধন দুঃশাসনের তালা। গীতিকবি আবু হেনা মোস্তফা কামালের ভাষায় জাতির দিনবদলের পালা শুরু হয়েছিল যেদিন, বাঙালির মননে অনন্য মহিমায় ভাস্বর চিরস্মরণীয় সেই দিন 'একুশে ফেব্রম্নয়ারি'। ইতিহাসের পাতায় রক্ত পলাশ হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর, আউয়াল, অহিউলস্নাহর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি আজ। মাতৃভাষার অধিকার চাওয়া বাঙালির রক্তস্রোতে ভেসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার দিন। আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব আজ মৃতু্যঞ্জয়ী ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানাবে। বিশ্বসত্তার শিকড়ে শিকড়ে আজ জেগে উঠবে প্রাণের চাঞ্চল্য। ধ্বনিত হবে ভাষা শহিদদের স্মরণে লেখা অমর গান 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারসহ সারাদেশের শহিদ মিনারগুলো ভরে উঠবে ফুলে ফুলে। খালি পায়ে জনতার মিছিল এসে মিলিত হবে শহিদ মিনারের পাদদেশে। শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় পালিত হবে ঐতিহাসিক এ দিন। আজ ভাষা সৈনিক সালাম, বরকত, রফিক, শফিউদ্দিন, জব্বারের রক্তের পথ ধরে পাওয়া স্বাধীনতার শত্রম্নদের বিচারের মাধ্যমে রক্তঋণ শোধ করার দিন। সময়ের সেই সাহসী সন্তানদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর দিন। আজ পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে মায়ের মুখের মধুর ভাষা বাংলাকে নিজের করে পাওয়ার দিন, আজ অঙ্গীকারে দৃপ্ত একুশে ফেব্রম্নয়ারি। নিকষ কালো অন্ধকার রাতের পর ভোরের কুয়াশা চিরে পুবের আকাশে আজ উঁকি দেবে যে সূর্য, তা যেন রক্তিম আজ ভাষা শহিদদেরই রক্তে। ফাল্গুনের রক্তরঙের পলাশ প্রতীক মহিমা এই দিনের। শহিদ মিনারে মিনারে কোমল পাপড়ি মেলে সুবাস ছড়াবে গাঁদা, গোলাপসহ হাজারো ফুল। শহর-নগর-বন্দর-গ্রামে উচ্চারিত প্রভাতফেরির যে ভাষা সে আমার মায়ের ভাষা। হারানো স্বজনের জন্য কেঁদে উঠবে মন। অশ্রম্নতে সিক্ত হবে শহিদ মিনারের প্রতিটি ফুল। একুশের রক্তস্নাত পথ বেয়েই কালক্রমে একুশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মানে হলো ভূষিত। কেবল বাঙালি নয়, নিজ ভাষা নিয়ে গর্বিত প্রতিটি জাতি আজ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজের মাতৃভাষা অর্থাৎ ৬ হাজার ৩১০টি ভাষার মানুষ নিজ নিজ ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। ২০০০ সাল থেকে একুশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাজপথ, দেয়াল সজ্জিত এখন বর্ণিল সাজে। চারুকলার শিক্ষার্থীরা রাত-দিন খেটে রঙতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছে প্রতিবাদের নানা ভাষা। রাতে প্রথম প্রহর থেকে জেগে ওঠা মানুষ সকালে দেখবে এক নতুন আকাশ, নতুন সূর্য। শহিদ মিনার বেদি, কালো রাজপথ, দেয়াল হেসে উঠছে বর্ণিল আল্পনায়। বীর ভাষা শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে পথে নামবে মানুষের ঢল। হাতে ফুল, মুখে অমর সে একুশের গান। নগ্ন পা-চিরচেনা সেই অন্তহীন মিছিল এসে থামবে স্মৃতির মিনারে। গভীর শ্রদ্ধায়, ফুলে, প্রাণের অঞ্জলিতে ভরে উঠবে মিনার প্রাঙ্গণ। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে সারাদেশে গড়ে তোলা মিনার, স্মৃতিস্তম্ভে সাজবে শ্রদ্ধার ফুলে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি ঢাকার রাজপথে ঘটেছিল বাঙালির ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার ঘটনা। 'বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা' স্স্নোগানে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয় বাঙালি তরুণ প্রাণ। ইতিহাসবিদদের মতে, ভাষার প্রশ্নে একুশের আন্দোলন হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তা ছিল শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ। সেদিন আত্ম-অধিকার, সমতাভিত্তিক সমাজ আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রবিনির্মাণের স্বপ্নে জেগে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। একুশের আন্দোলনেই ঘটে বাঙালির আত্মবিকাশ, যার ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে এসেছে অমৃত স্বাধীনতা। একুশে তাই বাঙালিত্বের চেতনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। একুশে শহিদদের ঠাঁই এখন প্রতিটি বাঙালির মর্মমূলে। পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় উচ্চারিত হয় একেকটি নাম। মহান ভাষা শহিদদের স্মরণে সারাদেশে, অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি বিদেশেও বাঙালিরা যে যেখানে রয়েছে, সেখানেই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হচ্ছে মহান আত্মত্যাগের এ দিনটি। রাষ্ট্রীয় আয়োজনে একুশের অনুষ্ঠানমালার সূচনা হবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন একুশের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা একুশের প্রথম প্রহরে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এরপর সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার। একুশের প্রথম প্রহরে জেগে ওঠে দেশ-বিদেশের সব শহিদ মিনার। বীর ভাষাশহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে ভোরের শিশির মাড়িয়ে নগ্নপদে শহিদ মিনার অভিমুখে এগিয়ে যাবে নারী, শিশু, বৃদ্ধসমেত অগণিত মানুষ। বেদিমূল ভরে উঠবে ভালোবাসার অর্ঘ্যে। আপন সংস্কৃতির বিকাশ আর সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলনের দাবিতে স্স্নোগানে স্স্নোগানে মুখর হবে শহিদ মিনার প্রাঙ্গণ। আজ সরকারি ছুটির দিন। দিবসটি স্মরণে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সংগঠন বিশেষ কর্মসূচি পালন করবে। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং শোকের প্রতীক কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শহিদ মিনার অভিমুখে প্রভাতফেরি, পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আজিমপুরে শহিদদের কবর জিয়ারত, দোয়া মাহফিল, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জাতীয় শহিদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাজধানীতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একুশের কর্মসূচি পালন করবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন দিনটি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারকে ঘিরে রাজধানীতে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।র্ যাব, পুলিশ, এপিবিএন ও আনসারসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য রয়েছে মোতায়েন। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ঘিরে বসানো হয় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। এছাড়া আশপাশ এলাকায় বসানো হয়েছে তিন ডজন চেকপোস্ট।র্ যাবের ডগ স্কোয়াড ও অত্যাধুনিক মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পুরো শহিদ মিনার এলাকা সুইপিং করা হয়। আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : মহান শহিদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ। এ উপলক্ষে একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দলের পক্ষ থেকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। ভোর সাড়ে ৬টায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে সংগঠনের সকল শাখা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হবে এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ৭টায় কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাত ফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহিদদের কবরে ও কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এছাড়া মহান শহিদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আগামী ২২ ফেব্রম্নয়ারী বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মহান শহিদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সব কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনের জন্য দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ সংগঠনের সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপির কর্মসূচি : শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস উপলক্ষে বিএনপি দুদিনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার ২০ ফেব্রম্নয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ ২১ ফেব্রম্নয়ারি ভোরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয়, দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা, সকাল ৬টায় কালো ব্যাজ ধারণ করে নেতা-কর্মীরা বলাকা সিনেমা হলের কাছ থেকে প্রভাত ফেরি করে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহিদদের কবর জিয়ারত এবং এরপর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। কেন্দ্রীয় দুদিনের কর্মসূচির পাশাপাশি মহান শহিদ দিবস উপলক্ষে সারাদেশে জেলা-উপজেলা-থানা ও সকল ইউনিট কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ, কালো পতাকা উত্তোলন ও স্থানীয় ভাষা শহিদদের স্মরণে স্মৃতি মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবে। ভাষা শহিদদের স্মরণে আলোচনা সভা করবে স্থানীয়রা।