ইউএনডিপির প্রতিবেদন

ধনী-গরিব গড় আয়ুর পার্থক্য ১৯ বছর

প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
অর্থের সঙ্গে জীবনযাত্রার মান যেমন সম্পৃক্ত, তেমনি মানুষের আয়ুও! বাস্তবে তাই দেখা গেছে। উচ্চ আয়ের মানুষের তুলনায় গড় আয়ুতে পিছিয়ে আছে নিম্ন আয়ের মানুষ। একটি শিশু নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নিলে তার গড় আয়ু হয় ৫৯ বছর। আর উচ্চ আয়ের ঘরে জন্ম নিলে তার গড় আয়ু হয় ৭৮ বছর। এই দুই ধরনের পরিবারে জন্ম নেওয়া মানুষের গড় আয়ুর মধ্যে পার্থক্য ১৯ বছর। জীবন-মৃতু্য, জ্ঞান-সুযোগ এবং জীবন-পরিবর্তনীয় প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অসমতা থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। শুক্রবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর একটি হোটেলে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) একটি বাংলা ফন্ট উদ্বোধন করেছে। এ সময় বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে সংস্থাটি তাদের গত বছরের (২০১৯) মানব উন্নয়ন রিপোর্টের সার সংক্ষেপ বাংলায় প্রকাশ করে। ওই রিপোর্টে এসব তথ্য জানানো হয়। ইউএনডিপির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান সময় মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে উলেস্নখযোগ্য সফলতা প্রত্যক্ষ করছে। অভূতপূর্ব সংখ্যক মানুষ সারা বিশ্বে বুভুক্ষা, ব্যাধি এবং দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে নূ্যনতম জীবনধারণের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে। এই উন্নয়ন সূচক নির্দেশ করে যে, প্রত্যাশিত আয়ের ক্ষেত্রে মূলত শিশুমৃতু্যর হার হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এতে বহু মানুষকে পেছনে ফেলে আসা হয়েছে এবং সব সক্ষমতার ক্ষেত্রে বহু অসমতাও রয়েছে। এই অসমতাগুলো জীবন-মৃতু্য, জ্ঞান-সুযোগ এবং জীবন-পরিবর্তনীয় প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিরাজমান। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিম্ন মানব উন্নয়ন ও উচ্চ মানব উন্নয়ন সূচক দেশগুলোর মধ্যে গড় আয়ুর ফারাক এখনো ১৯ বছর। প্রতি ধাপ বয়সেই প্রত্যাশিত আয়ুর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ৭০ বছর বয়স মাত্রার নিম্ন ও উচ্চ মানব উন্নয়ন সূচক দেশগুলোর মধ্যে প্রত্যাশিত গড় আয়ুর ফারাক প্রায় ৫ বছর। নিম্ন মানব উন্নয়ন দেশগুলোর মাত্র ৮২ শতাংশ মানুষ প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছে, যেখানে উচ্চতম মানব উন্নয়ন দেশগুলোতে এই হার ৯১ শতাংশ। শিক্ষার সব স্তরেই অসমতা রয়েছে। নিম্ন মানব উন্নয়ন দেশগুলোতে ৩.২ শতাংশ মানুষ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পেরেছে, যেখানে উন্নত দেশগুলোর ২৯ শতাংশ জনগণ উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত। আর প্রযুক্তিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশে প্রতি ১০০ জনের মাঝে ৬৭ জন মুঠোফোন গ্রাহক, আর উন্নত বিশ্বে এর সংখ্যা দ্বিগুণ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে-যারা পেছনে পড়ে আছে, তাদের মধ্যে ৬০ কোটি মানুষ চরম আয় দারিদ্র্যে বাস করে। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক পরিমাপ করলে তা এক লাফে ১৩০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ২৬ কোটি শিশু প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাবৃত্তের বাইরে এবং ৫৪ লাখ শিশু ৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে না। টিকাদান বা ব্যয়সাধ্য চিকিৎসা সুবিধা সত্ত্বেও বিশ্বের দারিদ্র্যতম দেশগুলোর দারিদ্র্যতম গৃহাঙ্গনে শিশুমৃতু্যর হার এখনো বেশি। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, 'এই রিপোর্টে একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য আছে। তা হলো- নিম্ন আয়ের ঘরে একটি শিশু জন্মালে তার গড় আয়ু হয় ৫৯ বছর। আর উচ্চ আয়ের ঘরে জন্মালে ওই শিশুর গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮ বছর। অর্থাৎ জন্ম থেকেই নিম্ন ও উচ্চ আয়ের মধ্যে বৈষম্য শুরু হয়।' তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত আমাদের পাঁচ থেকে ১০ লাখ কোটি ডলার তহবিল প্রয়োজন হবে। এর একটি অংশ সরকার সরবরাহ করবে। বাকি অংশ বেসরকারি খাত ও উচ্চ আয়ের দেশ এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর দেওয়ার কথা রয়েছে।' তবে উচ্চ আয়ের দেশগুলো এখন স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশকে নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী সহায়তা দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শূন্য থেকে এক মাস বয়সি শিশুর মৃতু্যঝুঁকি অনেক বেশি। এই ঝুঁকি পাঁচ বছরের নিচে পর্যন্ত থেকে যায়। জন্ম-পরবর্তী শ্বাসকষ্ট, কম ওজনের কারণে জন্মগত জটিলতা, নিউমোনিয়া, সেপটিসেমিয়া ও এনকেফেলাইটিস পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃতু্যর প্রধান কারণ। এ ছাড়া অপুষ্টির কারণেও মৃতু্য হয়। এক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা যথাযথ চিকিৎসা পায় না। যে কারণে তাদের মৃতু্যর হার বেশি। জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রোটেকশন সেক্টরের পরিচালক আবদুলস্নাহ আল মামুন বলেন, 'আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- নিম্ন ও উচ্চ আয়ের পরিবারের শিশুদের গড় আয়ুর যে পার্থক্য সেটি নানা করণে হয়ে থাকে। প্রথমত অপুষ্টি। অপুষ্টির সঙ্গে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির সম্পর্ক রয়েছে। আর রোগ-ব্যাধির কারণে মৃতু্য বেশি হয়। নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা যে ধরনের জীবনযাপন করে, তার কারণে তারা মৃতু্যঝুঁকিতে থাকে। বিশেষ করে খাবার ছাড়াও তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে। বায়ু ও পানিদূষণসহ নানা সংক্রামক ব্যাধিতে তারা বেশি আক্রান্ত হয়। পরিবেশদূষণের বড় শিকার হয় তারা। তিনি আরও বলেন, 'নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো রোগের প্রতিষেধক সরকারি টিকাগুলো দেয়। তারা এর বাইরে অন্যান্য টিকাগুলো দিতে পারে না। আর উচ্চআয়ের পরিবারের শিশুরা নয় বছর বয়স পার করলেই মেয়েরা ব্রেস্ট ক্যানসারসহ নানা রোগের টিকা দিয়ে থাকে। যেগুলো অর্থ দিয়ে কিনে দিতে হয়। জটিল রোগে আক্রান্ত হলেও তারা উন্নত বা ব্যয়বহুল চিকিৎসার সুযোগ পায়। এই সুযোগটা নিম্ন আয়ের ?পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে হয় না। চিকিৎসা নেওয়ার সক্ষমতার কারণেই এই পার্থক্যটা বাড়ছে। এসব কারণে শৈশবকালে এই গ্যাপটা তৈরি হচ্ছে। এ কারণেই গড় আয়ুর ক্ষেত্রে এই পার্থক্যটা দেখা দেয়।' বাংলা ট্রিবিউন