দেড় মাসে কমেছে ২১%

চীনা পণ্য আমদানিতে বড় ধাক্কা

রপ্তানিকারকদের আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না কেউ বিকল্প দেশ এখনো খুঁজে পাননি ব্যবসায়ীরা বেড়েছে শিল্পের স্থানীয় কাঁচামালের দাম

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
চীন থেকে শিল্পের কাঁচামাল ও বাণিজ্যিক পণ্য আমদানিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশে। চলতি অর্থবছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত মাত্র দেড় মাসে আমদানি কমেছে ২১ শতাংশ। কমে গেছে চীনের বন্দরগুলো থেকে বাংলাদেশমুখী জাহাজে পণ্য পরিবহণ। কোনো কোনো জাহাজে চীনের পণ্য পরিবহণ ৫০ শতাংশে নেমেছে। এ জন্য বাড়তে শুরু করেছে শিল্পের স্থানীয় কাঁচামালের দাম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হালনাগাদ তথ্যানুসারে, চীন থেকে বিভিন্ন পণ্যের আমদানির পরিমাণ এবং মূল্য উভয় ক্ষেত্রেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ( ২০১৯-২০) ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত যথাক্রমে ২০ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং ৮ দশমকি ২৯ শতাংশ কমেছে। এনবিআরের শুল্ক উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে উৎপাদন বা পোশাক খাতের প্রায় ৩০টি প্রধান পণ্যের আমদানি কমেছে ৭৬ শতাংশ। চীন থেকে আমদানি হওয়া উৎপাদন খাতের অন্যতম প্রধান পণ্যগুলো হলো- পোশাকের মেশিনারিজ, এক্সেসোরিস, ডেনিম ফেব্রিক, পেস্নইন কটন, ওভেন ফেব্রিক, সিনথেটিক সুতার বোনা কাপড়, রঙিন বোনা সুতির কাপড় এবং পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক। এনবিআরের তথ্য অনুসারে, চীন থেকে পণ্য আমদানি কমেছে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৩১১ টন। গত বছর ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৮ টন। আর চলতি বছরের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৮২৭ টন পণ্য। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের প্রভাব বিশ্লেষণ করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের (এমওসি) অনুরোধে এনবিআরের কাস্টমস উইং সম্প্রতি তথ্য প্রস্তুত করেছে। পোশাক খাতের নেতারা বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চীন থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ-সংক্রান্ত বর্তমান সংকট সম্পর্কে আলোচনায় বসেন। সভায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যায়যায়দিনকে বলেছেন, তারা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, পোশাক খাত যুক্তিসঙ্গত ব্যয়ে কাঁচামাল আমদানির জন্য চীনের বিকল্প নেই। তারা কাঁচামাল আমদানির জন্য কোরিয়া এবং ভারতের সরবরাহকারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন কিন্তু এতে দেখা গেছে তাদেরও কাঁচামালের মূল উৎস চীন। হাতেম অভিযোগ করেছেন, চীন থেকে আমদানি কমায় স্থানীয় কাঁচামাল যেমন ডাইস কেমিক্যাল এবং সোডা ইত্যাদির দামও ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের অধিকাংশ কাঁচামাল আসে যে চীন থেকে করোনাভাইরাসের কারণে সেখানে কারখানা ও মালের চালান বন্ধ থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু গার্মেন্ট কারখানা সচলের পণ্য নয়, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রিক্যাল সামগ্রী, কৃষি যন্ত্রপাতি, মেশিনারিজ পণ্য, স্টিলের কাঁচামাল, রাসায়নিক, চশমা সামগ্রী, পাদুকা, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, পেঁয়াজ-রসুন-আদা, মাল্টা, আপেল, কমলাসহ অন্যান্য পণ্য আসে চীন থেকে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীনের বড় শহরগুলো অচল হয়ে পড়ার আগেই দেশটিতে উৎসবের অন্যতম প্রধান উপলক্ষ নতুন চান্দ্রবর্ষ সামনে রেখে কারখানা বন্ধ হয়েছিল। ওই ছুটি শেষ হওয়ার পর কারখানা খুললেও শ্রমিকের অভাবে এখনো উৎপাদনে যেতে পারছে না তারা, আবার অনেক কোম্পানির খোঁজ এখনো মিলছে না বলে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে চীনের রপ্তানিকারকরা আশ্বাস দিলেও তাতে পুরোপুরি ভরসা করতে পারছেন না বাংলাদেশিরা। চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, চীনে পরিস্থিতির উন্নতি হলে আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি গতিতে বন্দরের কার্যক্রম চালিয়ে ক্ষতি পোষানো হবে। তবে তারা আশ্বাস দিলেও দিন দিন গার্মেন্ট মালিকদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মশিউল আজম সজল। তিনি বলেন, এই কয় দিনে সাপস্নাই চেইন মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং এটা দিন দিন বাড়ছে। এই পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে দিন দিন কারখানা মালিকদের মাথায় দুশ্চিন্তা ভর করছে। কারণ একদিকে কার্যাদেশ কমছে, অন্যদিকে কাঁচামালের জোগান কমছে। এই অবস্থায় বায়ারদের সঙ্গে কোনো দর-কষাকষি তো দূরে থাক, কার্যাদেশও নেওয়া যাচ্ছে না। এখনই চীনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এর ধাক্কা আগামী এপ্রিল-মে মাস পর্যপ্ত পড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে এক লাখ ১৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে, যা ওই বছরের মোট আমদানির ২৬ শতাংশ। পোশাক ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, পোশাক খাতের ৩৭টি থেকে ৪০টি কাঁচামালের অধিকাংশ পণ্যই আমদানি করা হয় চীন থেকে। বিভিন্ন ধরনের সুতা, ফেব্রিক্স, জিপার, বোতাম রয়েছে এর মধ্যে। এসব পণ্যের বিকল্প বাজার থাকলেও আমদানিকারকরা এখনই চীনের বিকল্প হিসেবে অন্য দেশকে বেছে নিতে চাচ্ছেন না। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯২ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে এই খাত। চীনের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিজিএমইএ নেতা মশিউল আজম সজল বলেন, সেখানে কিছু কিছু অফিস চালু হয়েছে। কিন্তু কারখানাগুলো চালু হয়নি। সেখানে ৬০ শতাংশ শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হতে পারেনি। কখন যে এই অবস্থার উন্নতি হবে সেটা কেউ বলতে পারছে না। ফেইম সুয়েটারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সজল জানান, চীন থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ থাকায় ইতোমধ্যেই দেশের মধ্যে অনেক কারখানায় ৩-৪টি করে লাইন অচল হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি যদি আরও বাড়তে থাকে তাহলে ব্যাপক বেকারত্বের সৃষ্টি হবে। কারণ শত শত শ্রমিককে বসিয়ে রেখে বেতন দেওয়া কোনো কারখানার পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশ যে ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান কিংবা তুরস্ক তার চেয়ে একটু সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বলে মন্তব্য করেন এই গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, পাকিস্তানের 'ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের' নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। আর ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় সড়ক পথে ট্রাকযোগে পণ্য চলে আসে চীন থেকে। বাংলাদেশে সরাসরি জাহাজ আসতেও ১৫ দিন সময় প্রয়োজন, সাধারণত জাহাজগুলো আসতে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় নিয়ে থাকে। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চীনের করোনাভাইরাসের স্বল্পকালীন প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। আবার যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল নির্ধারিত সময়ে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। রোগটি দ্রম্নত প্রশমন করা না গেলে পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে। মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, 'বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের এক-চতুর্থাংশ চীন থেকে আসে। এ ধরনের অতিনির্ভরশীলতা ভালো নয়। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। বেশি আমদানি হয়, এমন পণ্যের বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আমদানির সময় ও দামের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, কম সময়ে পণ্য প্রাপ্তি ও প্রতিযোগিতামূলক দামের কারণেই চীন থেকে আমাদের আমদানি বেড়েছে। সিপিডির এই গবেষক বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধ, করোনাভাইরাসসহ নানা কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চীনের বিকল্প দেশ খুঁজছেন। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজ দ্রম্নত শেষ করে সুযোগটি নেওয়া। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া কিন্তু বিনিয়োগকারীদের নিজেদের দেশে টানছে।