সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা

পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনীহার নেপথ্যে কোটি টাকার বাণিজ্য

প্রকাশ | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

নূর মোহাম্মদ
ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার এ কাংশ -ফাইল ছবি

বিশেষ অধ্যাদেশে স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হওয়ার অজুহাতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা থেকে ছুটে গেল বুয়েট, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষা মানসম্পন্ন ও আইনসম্মতের কথা বলে শীর্ষ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত পদ্ধতি থেকে সরে যাওয়ায় পুরো উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রিসহ এ খাত থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে বলেই ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত পদ্ধতিতে আসতে চায় না। ইউজিসির অর্থ শাখার তথ্যমতে, গত অর্থ বছরে এ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে কয়েক কোটি আয় করেছে, যা শিক্ষক-কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করেছেন। ফরম বিক্রির ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা রাখার বিধান থাকলেও এ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় নামেমাত্র টাকা জমা রেখে দায় সেরেছে। বাকি টাকা ইচ্ছেমাফিক খরচ করা হয়েছে। বুয়েট কর্তৃপক্ষ ভর্তি ফরম বিক্রির টাকা ফান্ডে জমা রাখার পরিবর্তে ভর্তি খরচ জোগাতে উল্টো ফান্ড থেকে টাকা নিয়েছে। এদিকে ২৬ ফেব্রম্নয়ারি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসি। সেখানে আপাতত ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এটা সফল হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু করতে চায় সংস্থাটি। ইউজিসির তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক খরচের যে হিসাব ইউজিসির কাছে দিয়েছে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ভর্তি ফরম বিক্রি করে আয় করেছে ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এ টাকার ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডে জমা রাখার বিধান থাকলেও ঢাবি রেখেছে মাত্র ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করেছে কোটি টাকার বেশি। পরের অর্থবছরে আয় করে ৭ কোটি ২৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। ওই বছর জমা দেয় মাত্র ১ কোটি ১ লাখ অর্থাৎ মাত্র ১৪ শতাংশ। বাকি টাকা শিক্ষক-কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। একই অবস্থা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ বিশ্ববিদ্যালয় ফরম বিক্রি করে আয় করেছে ৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকার বেশি। ওই বছর ৪০ শতাংশ ফান্ডে জমা দিলেও পরের অর্থ বছরে সেটি ১৪ শতাংশে নেমে আসে। ওই বছর ফরম বিক্রিতে আয় করে ৭ কোটি ৮৯ লাখ ৬১ হাজার টাকা। বাকি টাকা শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একই অর্থ বছরে আয় করেছে ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ওই বছর মাত্র ৩০ শতাংশ টাকা ফান্ডে জমা দিয়েছে। পরের বছর আয় করে ১০ কোটি ৭ লাখ টাকা। ওই বছর ফান্ডে জমা দেয় মাত্র ২০ শতাংশ। অর্থাৎ ফরম বিক্রির ৮০ শতাংশ ভর্তি টাকাই নিজেদের মধ্যে ভাগ করেছেন। সবচেয়ে বেশি দুরবস্থা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ বিশ্ববিদ্যালয় ফরম বিক্রির টাকা ফান্ডে জমা তো দিতেই পারেনি উল্টো ভর্তি খরচ জোগাতে গিয়ে ফান্ড থেকে টাকা নিয়েছে। ইউজিসির দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ বিশ্ববিদ্যালয় ফরম বিক্রি বাবদ আয় করেছে ৬৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। ওই বছর ভর্তি-সংক্রান্ত কাজে খরচ হয়েছে ৭৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডে জমা দেওয়ার পরিবর্তে নিয়েছে ৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। পরের অর্থবছরে আয় করে ৭৪ লাখ টাকা। ওই বছর খরচ হয় ৯৬ লাখ ৫ হাজার। অর্থাৎ আরও ২২ লাখ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ড থেকে নিয়েছে। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ওই দুই বছর ৪০ শতাংশ হারে বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডে জমা দিয়েছে। এর পরের বছরগুলোর ফরম বিক্রির হিসাব বারবার ইউজিসি থেকে চাওয়া হলেও গড়িমসি করে তারা। সর্বশেষ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ টাকার হিসাব দিতে পারেনি। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি হিসাব দিতে পারেনি। ওই দুই অর্থবছরে টাকা জমা দেওয়ার শীর্ষে ছিল সশন্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল। তারা যথাক্রমে ৬১ ও ৪০ শতাংশ ফান্ডে জমা রেখেছে। জমা দেয়ার সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। তারা দুই অর্থবছরে জমা দিয়েছে যথাক্রমে ১১ ও ৩ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয় করে ২ কোটি ৬৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। ফান্ডে জমা দিয়েছে মাত্র ৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা। বাকি ২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা খরচ করেছে। যা সাগর চুরির মতো অবস্থা। ইউজিসির একজন সদস্য যায়যায়দিনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একাধিকার তাগিদ দিয়েছেন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের গণভবনে ডেকে সমন্বিতভাবে ভর্তি করার জন্য নির্দেশ দেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তারপরও শীর্ষ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ মুহূর্তে সরে যাওয়া দুঃখজনক। এদিকে আপাতত ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়েই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। ইউজিসির আশা, জনকল্যাণে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসবে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আস্থা অর্জন করা গেলে পরবর্তীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও চালু করা হবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩'র অধ্যাদেশ অনুযায়ী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয়, অন্যদিকে বুয়েটও পরিচালিত হয় বিশেষ আইন মোতাবেক। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় বাধ্য করতে পারছে না ইউজিসি।