নিশানা মুসলমানরাই মার্কিন প্রতিবেদন

দাঙ্গাবিধ্বস্ত দিলিস্নতে নিহত বেড়ে ৩৬

প্রকাশ | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
সিএএ ও এনআরসি কেন্দ্র করে ভারতের রাজধানী দিলিস্নতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। ছবিটি বুধবার তোলা -সংগৃহীত
ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জিকে (এনআরসি) কেন্দ্র করে রাজধানী দিলিস্নতে দুই পক্ষের মধ্যে যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩৬ জনে দাঁড়িয়েছে এবং আহতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। তবে টানা চার দিন ধরে সহিংসতার পর উত্তর-পূর্ব দিলিস্নর সহিংসতাকবলিত এলাকা কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে। প্রচুর পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তারা নিয়মিত 'ফ্ল্যাগ মার্চ'ও করছে। নতুন করে আর খুব বেশি সহিংসতা হয়নি। পুলিশের দাবি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, 'সহিংসতাকবলিত জাফরাবাদের প্রধান রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে। দোকানপাটও খুলেছে। রাস্তায় কিছু গাড়িও চলছে। আরেক এলাকা মৌজপুরের চিত্রও একই। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল 'ভরসা' দেওয়ার পর মূল রাস্তার দুই পাশ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক।' এর আগে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি 'শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের' আহ্বান জানান। সংবাদসূত্র : এনডিটিভি, এবিপি নিউজ, বিবিসি, এএনআই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফর চলাকালেই গত রোববার রাজধানী দিলিস্নতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) সমর্থক ও বিরোধীদের পাল্টাপাল্টি মিছিল থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে এবং হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় রূপ নেয়। বুধবার রাতেও মুসলমান অধু্যষিত উত্তর-পূর্ব দিলিস্নর ভজনপুরা, মৌজপুর ও কারাওয়াল নগরে অগ্নিসংযোগ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিকে, দাঙ্গা শুরু হওয়ার চতুর্থ দিনে এসে প্রথমবারের মতো এক বিবৃতিতে 'শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের' ডাক দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোদি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একের পর এক 'রিভিউ মিটিং' করে গেলেও দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে দাবি করে দিলিস্ন পুলিশ ১৮ মামলা ও সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ১৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে। দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষুব্ধ দিলিস্ন হাইকোর্ট পুলিশকে ঘৃণা ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে বলেছে। চার বিজেপি নেতার বক্তৃতার ভিডিও দেখার পর আদালত এমন নির্দেশনা দেয়। ওই বিজেপি নেতাদের মধ্যে কেন্দ্রের মোদির সরকারের মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর ও স্থানীয় নেতা কপিল মিশ্রও আছেন। রোববার বিকালে এই কপিল মিশ্রের সমাবেশ থেকেই সহিংসতা শুরু হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। দিলিস্নতে শান্তি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভারতের ?নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে। বুধবার সন্ধ্যায় তিনি দ্বিতীয়বারের মতো নগরীর দাঙ্গা-কবলিত এলাকাগুলোতে যান। দাঙ্গায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর একটি জাফরাবাদ এলাকায় পুলিশের গাড়িবহর নিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'শিগগিরই দিলিস্নতে শান্তি ফিরে আসবে।' এর কিছুক্ষণের মধ্যেই এক তরুণী এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে সাহায্যের জন্য করুণ আর্তি জানান। দাঙ্গাকারী সবাইকে ধরা হবে বলে তিনি ওই তরুণীকে আশ্বাস দেন। বুধবার দিলিস্নর বিধানসভায় দেওয়া এক বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন, 'সহিংসতায় হিন্দু বা মুসলমান, কারও লাভ হবে না। দিলিস্নর সামনে এখন দুটি পথ খোলা আছে- লোকজন সবাই মিলেমিশে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে, অথবা তারা একে অপরকে আঘাত করে হত্যা করতে পারে।' এই সহিংসতার জন্য বহিরাগত ও রাজনৈতিক উসকানিকে দায়ী করেন তিনি। এর আগে দাঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী নামানোর দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অমিত শাহের দায়িত্বে থাকা ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার দাবি প্রত্যাখ্যান করে। যদিও বৃহস্পতিবার সেনা মোতায়েন করা হয়। এদিকে, দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের তীব্র সমালোচনা করেছেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে অমিত শাহের পদত্যাগ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। সোনিয়া গান্ধী দিলিস্নর মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালেরও সমালোচনা করেন। রোববার সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার ও দিলিস্নর সরকার উভয়েই পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। রাষ্ট্রপতির দরবারে 'রাজধর্ম' পালনের আরজি সোনিয়ার দিলিস্নর দাঙ্গায় একদিকে বহু প্রাণ ঝরছে, অন্যদিকে বিজেপি-আপ 'নীরব দর্শক'-এর ভূমিকা পালন করছে। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের কাছে গিয়ে তাই তাদের 'রাজধর্ম' পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার আবেদন জানান কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। পাশাপাশি সহিংসতা সামলানোয় 'ব্যর্থ' স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগও দাবি করেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি ভবনে রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করতে যান সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের প্রতিনিধিদল। সোনিয়া ছাড়াও সেই দলে ছিলেন মনমোহন সিং, পি চিদাম্বরম, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীসহ কংগ্রেস নেতারা। দিলিস্নতে বাড়তে থাকা সহিংসতায় উদ্বিগ্ন কংগ্রেস সভানেত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। ওই স্মারকলিপিতে লেখা রয়েছে, 'সরকারের বিবেককে রক্ষা করা এবং সরকারকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং রাজধর্ম স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতীয় সংবিধানে আপনাকেই সর্বোচ্চ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।' নিশানায় মুসলমানরাই, দাবি মার্কিন কমিশনের, খারিজ দিলিস্নর অন্যদিকে, ভারত সফরে থাকাকালীন দিলিস্নর পরিস্থিতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তিনি ফিরে যেতেই গোটা ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মার্কিন কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ)। তাদের অভিযোগ, বেছে বেছে মুসলমানদের ওপরই হামলা চালানো হচ্ছে। অথচ সব দেখেশুনেও নীরব সরকার। নৃশংস এবং লাগামছাড়া সহিংসতা রুখে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ তারা। তবে মার্কিন ওই সংগঠনের অভিযোগ খারিজ করে 'দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য' থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর। দিলিস্নর পরিস্থিতি নিয়ে ভারতজুড়ে এরই মধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তবে মার্কিন ওই সংগঠনের মন্তব্যের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবিশ কুমার বলেন, 'ইউএসসিআইআরএফের অভিযোগ একেবারেই সঠিক নয়, বিভ্রান্তিমূলক। বরং মনে হচ্ছে, বিষয়টির রাজনীতিকরণই ওদের উদ্দেশ্য। সহিংসতা রুখে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা আমাদের সংস্থাগুলো। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা বিষয়টি তদারকি করছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন। এমন সংবেদনশীল সময়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো মন্তব্য না করতে অনুরোধ জানাচ্ছি আমরা।' মার্কিনিদের সতর্কবার্তা যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সফর শেষে দেশে ফেরার পরই দিলিস্নতে মার্কিন নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে তার সরকার। বুধবার একটি নির্দেশিকা জারি করে ভারতে থাকা মার্কিনিদের 'উত্তেজনাপূর্ণ এলাকা এড়িয়ে চলতে' বলেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বুধবার জারি করা নির্দেশিকায় দিলিস্নর সহিংসতার ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে সাবধান করা হয়েছে ভারতে থাকা মার্কিনিদের। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'উত্তর-পূর্ব দিলিস্নতে হিংসাত্মক প্রতিবাদ চলছে। ভারতে থাকা মার্কিন নাগরিকদের সেই কারণে সাবধানে চলাফেরা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যেসব এলাকায় গন্ডগোল চলছে, সেগুলোও এড়িয়ে চলুন।'