বহিষ্কার নয়, আইনগত ব্যবস্থা

বেপরোয়াদের লাগাম টানতে আরও কঠোর হচ্ছে আ'লীগ

দলের যেকোনো নেতাই অপরাধ দুর্নীতির সীমা অতিক্রম করলে, তার বিরুদ্ধেই দল কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে- এ বার্তা জনমনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে

প্রকাশ | ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর ক্ষমতার অপব্যবহারকারী দুর্নীতিবাজ নেতারা গ্রেপ্তার আতঙ্কে তটস্থ হয়ে উঠলে এ কার্যক্রমে কিছুটা ভাটার টান পড়ায় ফের অনেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে খোদ দলীয় সভানেত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে কেউ কেউ আগের চেয়ে আরও বেশি দাপটের সঙ্গে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এসব অপকর্মের তথ্য একের পর এক জনসম্মুখে উঠে আসায় সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব চরম অস্বস্তিতে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী ওইসব বেপরোয়া নেতার লাগাম টানতে দলীয় হাইকমান্ড আরও কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভয়াবহ অপরাধ-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া পদধারী নেতাদের শুধু দল থেকেই বহিষ্কার নয়, তাদের বিরুদ্ধে যাতে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সে ব্যাপারেও ইতিমধ্যে জোরাল নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দলীয় নেতাদের অপকর্ম গোপন না করে বরং তা তথ্য-প্রমাণাদিসহ ফাঁস করার জন্য তৃণমূলে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। দলীয় হাইকমান্ড মনে করে, নেতাদের অপরাধ-দুর্নীতি ফাঁস হলে দলীয় ইমেজ যতটা ম্স্নান হবে, তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ও আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে দলের ভাবমূর্তি তার চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল হবে। দলের যেকোনো নেতাই অপরাধ-দুর্নীতির সাধারণ সীমা অতিক্রম করলে, তার বিরুদ্ধেই দল কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে- এ বার্তা জনমনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন দলের নীতিনির্ধারকরা। অন্যদিকে সরাসরি অপরাধ-দুর্নীতিতে সরাসরি জড়িত না থাকলেও দলের যেসব নেতার অতিরিক্ত ক্ষমতার দাপটের কারণে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে এবং সেখানকার সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে তাদের বিরুদ্ধেও আরও কঠোর হচ্ছে আওয়ামী লীগ। তাদের সরাসরি দল থেকে বহিষ্কার করা না হলেও কৌশলে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন দাপুটে নেতাকে ধাপে ধাপে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে। এছাড়া বেপরোয়া নেতাদের আরও একটি দীর্ঘ তালিকা হাতে নিয়ে দলীয় হাইকমান্ড নানামুখী পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা শুরু করেছে বলে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া বেপরোয়া নেতারা যাতে আগামীতে আওয়ামী লীগ কিংবা এর সহযোগী সংগঠনের কোনো কমিটিতে পদ-পদবি না পান সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য দলীয় হাইকমান্ড কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। এদের পদ-পদবি দিতে দলের প্রভাবশালী কেউ চাপ প্রয়োগ করলে কিংবা সুপারিশ করলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য জানান, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনার অভিযোগে ইতিমধ্যে সাবেক ছয় মন্ত্রীসহ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতাদের একটি বড় তালিকা দলীয় সভানেত্রীর হাতে আছে। তিনি সেগুলো নিজস্ব সোর্স দিয়ে যাচাই-বাছাই করছেন। যার বিরুদ্ধেই অপরাধ-দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততা এবং ক্ষমতার দাপটে বেপরোয়া হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তিনি দলের জন্য যতটাই প্রয়োজনীয় হোন না কেন তার বিরুদ্ধে দ্রম্নত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিজে অপরাধ-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও এ ধরনের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত অন্য কাউকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলে তাকেও সমভাবে দায়ী করা হবে। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা জানান, আওয়ামী লীগে যে বেশ আগেই এ ধরনের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে, তা চট্টগ্রামের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হওয়া যাবে। স্থানীয় রাজনীতির গ্রম্নপিংয়ে নেতৃত্ব দেওয়া উপমন্ত্রী নওফেল ও মেয়র নাছিরকে ধাপে ধাপে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে। শিক্ষা উপমন্ত্রীর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। দুই মাস আগে তাকে সেই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার বদলে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে তৃণমূল থেকে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির রেজাউল করিম চৌধুরীকে মেয়রপ্রার্থী করা হয়েছে। দলীয় কোন্দলে ইন্ধন দেওয়াতেই দুই মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামের আলোচিত দুই নেতার ক্ষমতা এভাবে খর্ব করা হয়েছে বলে মনে করেন অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এই দুই প্রভাবশালী নেতার কোন্দলে মূল দলের সাংগঠনিক শক্তি বেশখানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। যা সামাল দিতেই দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা এ ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। ওই সূত্র জানায়, শুধু এ দুই ক্ষমতাধর নেতাই নয়, দলীয় সভানেত্রীর তালিকায় চট্টগ্রামের আরও বেশ কয়েকজন বেপরোয়া নেতার নামও রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগ নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সহসাই তাদের বিরুদ্ধেও 'অ্যাকশন' নেওয়া হবে। এর আগে অনেকটা একই কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনকেও কৌশলে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে। তাকে দ্বিতীয় দফায় মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন না দিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়েছে। অথচ তিনি ফজলে নূর তাপসের ছেড়ে দেওয়া ঢাকা-১০ আসনে মনোনয়ন চাইলে দল তাতে সাড়া দেয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, সাঈদ খোকনকে নিয়ে দক্ষিণ ঢাকা মহানগরীর নেতাকর্মী ও ঢাকাবাসী অনেক আশায় ছিল, তিনি নগরের উন্নয়নে জোরাল ভূমিকা রাখবেন। তবে এতে তিনি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দলের ভাবমূর্তি তো বাড়াতে পারেননি, উল্টো বিতর্কিত করেছেন। এছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তার মানসিক দূরত্ব ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সব মিলিয়ে সাঈদ খোকনের ওপর দল যে আস্থা রেখেছিল, তা তিনি পূরণ করতে পারেননি। আর এসব কারণে তার ক্ষমতা কমাতে রাজনৈতিক 'লাগাম' পরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এদিকে সম্প্রতি নরসিংদী যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউর অপকর্মের সঙ্গে দলের আরও বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সম্পৃক্ততার তথ্য ফাঁস হওয়ার পর দলীয় সভানেত্রী আরও কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি সারাদেশে এ সংগঠনের অপকর্মের সঙ্গে আর কারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন। দলীয় সভানেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার এমনটাই দাবি করেছেন। এর আগে পাপিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে কারা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাদেরও খুঁজে বের করা হবে বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন। অন্য একটি সূত্র বলছে, দলীয় সভানেত্রী এ ঘটনায় এতটাই ক্ষুব্ধ যে, তিনি যুব মহিলা লীগের কমিটি বাতিল করতে পারেন। অথবা নানা অপকর্মের আশ্রয়দাতা ও বেপরোয়া শীর্ষস্থানীয় কয়েকজনকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত আছে। এ জন্য শুদ্ধি অভিযানও শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, যারা বিভিন্ন সময় বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছেন কোনো কমিটিতে তাদের ঠাঁই পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা কেন্দ্রে হোক বা ঢাকা মহানগরে হোক, কোনো কমিটিতে তারা স্থান পাবে না।