অবগুণ্ঠন ভেঙে রাজপথে নারী

প্রকাশ | ২৩ মার্চ ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
একাত্তরের ২৩ মার্চ। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল এদিনে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ চট্টগ্রামের জেএম সেন হলে এক বিরাট মহিলা সমাবেশ করে। এতে সংগঠনের সভানেত্রী বেগম সুফিয়া কামাল ও সাধারণ সম্পাদিকা মালেকা বেগমসহ হান্নান বেগম, কুন্ড প্রভাসেন, সীমা চক্রবর্তী, মুস্তারী শফি, শিরিন শফিউলস্নাহ প্রমুখ নেত্রী বক্তৃতা করেন। মহিলা পরিষদের নেত্রীরা নারীর অবগুণ্ঠন ভেঙে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এখন আর ঘরে চুপ করে বসে থাকার সময় নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও বলে গেছেন। তাই সবাইকে এখন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে শত্রম্নর মোকাবিলা করতে হবে। এদিনে টঙ্গী, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকদের মিছিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গুলিতে বহু বাঙালি হতাহত হন। একাত্তরের এদিনে দেশের সর্বত্র উড়ল স্বাধীন বাংলার পতাকা, যা বাঙালির মুক্তির আন্দোলনে যোগ করে এক ভিন্নমাত্রা। ভোরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে নিজ হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ঢাকার প্রতিটি দূতাবাসেও এদিন পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের পতাকা। দু-একটি দূতাবাসে ভোরে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করা হলেও সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়। এছাড়া বিচারপতিদের বাসভবন, রেডিও, টেলিভিশন, সব বিদেশি মিশন, সচিবালয়, হাইকোর্টসহ সব স্থানেই পতপত করে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে এদিন দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও মহকুমা শহরেও স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পরামর্শে ইকবাল হলের ছাত্র শিবনারায়ণ দাস বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত একটি পতাকা তৈরি করেন। এ পতাকাটি সারাদেশেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রাজপথ, ভবন, গাছের চূড়া, লাঠি-বর্শা-বন্দুকের মাথায় নতুন পতাকা উড়িয়ে মিছিলে মিছিলে গর্জে উঠেছে বাঙালি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলার পর প্রভাতফেরি বের করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রছাত্রী ও সাবেক বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত 'জয় বাংলা বাহিনী'র আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ ও মহড়া। এ বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় জাতীয় পতাকার প্রতি অভিবাদন জানান। সকাল ও সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ ও সামরিক জান্তা ইয়াহিয়ার পরামর্শদাতাদের মধ্যে দুই দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেন এবং ইয়াহিয়ার পক্ষে এম এম আহম্মদ, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান বৈঠকে অংশ নেন। খান আবদুল কাইয়ুম ও জুলফিকার আলী ভুট্টো পৃথকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে এদিন ঢাকা টেলিভিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টেলিভিশন সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়, যাতে পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শন করতে না হয়। রেডিওতে বারবার জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা' বাজানো হয়। এদিনই পূর্ববাংলার বাঙালিরা স্বাধীনতা ও স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।