বাজারে আস্থার সংকট

নিত্য খাদ্যপণ্য অতিরিক্ত মজুত করছে সবাই বাজারে সাবান সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি হ্যান্ড সেনিটাইজার, হ্যান্ডি রাব উধাও

প্রকাশ | ২৩ মার্চ ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
মরণব্যাধি করোনাভাইরাসের কারণে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি হ্রাস এবং দেশে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা ছড়িয়ে অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বেশ ক'দিন ধরেই বাজার উত্তপ্ত করে তোলার জোরাল পাঁয়তারা করছে। এরই মধ্যে তারা পুরানো কৌশলে চাল, ডাল, আলু, তেলসহ বেশকিছু দৈনন্দিন খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ওপর করোনাভাইরাসের কারণে প্রয়োজন হলে আন্তঃজেলা যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধ করা হবে- সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে নিত্যভোগ্য পণ্যের বাজার নতুন করে তেতে উঠেছে। অথচ দেশে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট নেই বলে খোদ খাদ্যমন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন। খাদ্য ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও এ ব্যাপারে একই কথা বলছেন। তবে এসব কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বস্তরের মানুষ অতিরিক্ত নিত্যখাদ্যপণ্য মজুতে রীতিমতো পালস্নায় নেমেছে। বাজার পর্যবেক্ষকদের অভিমত, দেশের বাজার ব্যবস্থার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এ ব্যাপারে জনআস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক মাস আগে ২৫/৩০ টাকার পিঁয়াজের ডাবল সেঞ্চুরি এবং এ দর নিয়ন্ত্রণে সরকারের চরম ব্যর্থতা জনগণের আস্থায় বড় চির ধরেছে। প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের পরও পিঁয়াজের দাম না কমায় সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসন বাজার সিন্ডিকেটের কাছে কতটা জিম্মি সে চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। তাই কারও কথায় কান না দিয়ে ভোক্তারা সবাই যে যার মতো করে অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ করছে বলে মনে করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। এদিকে এ ধারা অব্যাহত থাকলে নিম্নবিত্ত পেশাজীবী মানুষকে চরম বিপাকে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, নিম্নবিত্তের এ শ্রেণির মানুষের হাতে তেমন সঞ্চয় থাকে না। তারা তাদের দৈনন্দিন আয় দিয়েই খাদ্যপণ্য কিনে জীবন ধারণ করে। তাই খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও তারা মধ্যবিত্ত চাকরি কিংবা উচ্চবিত্তের সঙ্গে পালস্না দিয়ে অতিরিক্ত কিনে মজুদ করতে পারবে না। ফলে নিত্যখাদ্য পণ্যের উচ্চদরের ঘানি অনেকটা তাদেরই টানতে হবে। যা তাদের জন্য 'মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ' হয়ে দাঁড়াবে। যার প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অনুমান যে অমূলক নয়, তা নিম্নবিত্তের পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে কথা বলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। রাজধানীর একাধিক রিকশাচালক ও দিনমজুর জানান, দেশে করোনার বিস্তার ঘটার পর বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। একই কারণে চলমান অনেক নির্মাণ কাজও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তাদের কর্ম ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় খাদ্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে তাদের না খেয়ে মরার দশা হবে। এদিকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের অনেকেই অতিরিক্ত খাদ্য মজুদের কথা মুখে স্বীকার না করলেও পাড়া-মহলস্নার দোকানি, বাজারের আড়াতদার থেকে শুরু করে খুচরা দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে। তাদের সবারই ভাষ্য, গত কয়েকদিন ধরে মানুষ যেন বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। যে যার মতো করে সাধারণ সময়ের চেয়ে তিন চারগুণ চাল-ডাল-আলু-তেল-মসলাসহ নানা খাদ্যপণ্য কিনছে। প্রতিটি জিনিসের দাম আগের চেয়ে কেজিপ্রতি ৩/৪ টাকা বাড়লেও তারা তাতে থোড়াই কেয়ার করছে। এতে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বাজার সিন্ডিকেটের অপকৌশল এরই মধ্যে সফল হতে বলে জানান দোকানিরা। অন্যদিকে ভোক্তারা অনেকে অতিরিক্ত খাদ্য মজুত করার কথা স্বীকার করলেও এ জন্য তারা বাজার ব্যবস্থায় সরকারের ব্যর্থতা এবং এ নিয়ে তাদের আস্থাহীনতার কথা জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, দুর্যোগকালীন অধিকাংশ সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে বাজার সিন্ডিকেটকে সামাল দিতে পারেনি। এমনকি খাদ্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যা তাদের আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। এ কারণে যে যেভাবে পারছে সংকটকালীন মুহূর্ত সামাল দেওয়ার জন্য নিজের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ওবায়েদ উল্যাহ এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে এসিআই ও এসকেএফসহ বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির হ্যান্ডি রাব ও হ্যান্ড সেনিটাইজার উৎপাদন করে। এছাড়া গায়ে মাখা ও কাপড় কাচা সাবানের প্রায় দুই ডজন বড় ফ্যাক্টরি রয়েছে। অথচ করোনা প্রতিরোধে সবাইকে হ্যান্ডি রাব, হ্যান্ড সেনিটাইজার ও সাবান দিয়ে ঘনঘন হাত ধোয়ার পরামর্শ দেওয়ার পর বাজারে এর ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গত ১০ মার্চের পর থেকে হ্যান্ডি রাব ও হ্যান্ড সেনিটাইজার বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। গায়ে মাখা ও কাপড় কাচা সাবান পাওয়া গেলেও খুচরা দোকানিরা যে যার মতো করে অতিরিক্ত দাম নিচ্ছে। দেশে উৎপাদিত এসব পণ্যের বাজার সামাল দিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যে ব্যর্থতা দেখিয়েছে, এরপর বাজার ব্যবস্থার ওপর আস্থা ধরে রাখা কঠিন বলে মন্তব্য করেন প্রবীণ এ অধ্যাপক। এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাজারে খাদ্যপণ্যের ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হবে এ আতঙ্কে সবাই একসঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে রাখার হুড়োহুড়িতে নেমেছে। পাড়ামহলস্না থেকে শুরু করে বাজারঘাটের ছোট-বড় প্রতিটি মুদি ও মাছ-মাংসের দোকানসহ খাদ্যপণ্যের দোকানে উপচেপড়া ভিড়। ক্রেতারা সবাই সয়াবিন, পামতেল, ডাল, ডিম, আলু, সাবান, সোডা ও শিশুখাদ্য পালস্না দিয়ে কিনছে। এসব পণ্যের প্রতিটির দাম বেশখানিকটা বেড়েছে। এর মধ্যে মানভেদে চালের দাম কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। ডাল-চিনির দাম তিন-চার টাকা বাড়তি। আলুর দাম কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। ফার্মের ডিম ১০০ টাকা ডজনে বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। আতঙ্কের কেনাকাটায় দরদাম করার সুযোগ না থাকায় দোকানিরা ক্রেতাদের কাছ থেকে যে যার মতো করে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এদিকে শিশুখাদ্যের দাম এরই মধ্যে লাগামহীন হয়ে পড়েছে। দেড় হাজার টাকার গুঁড়া দুধ কোথাও কোথাও ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে এ জন্য দোকানি ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দুষছেন। দোকানিরা জানান, মালয়েশিয়ার একটি ব্র্যান্ডের শিশুখাদ্য (গুঁড়া দুধ) যা আগে তারা আড়াই হাজার টাকায় কিনত, তা এখন পাইকারিতেই ২ হাজার ৮০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। যা তারা ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। তবে আমদানিকারকদের ভাষ্য, বিদেশি শিশুখাদ্যের কোনো সংকট নেই। বেশ কয়েকজন আমদানিকারক সম্প্রতি এসব পণ্যের বড় চালান এনেছে। যার মজুত শেষ হতে আরও অন্তত এক মাস লাগবে। এর আগেই হয়তো সারা বিশ্বেই বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ওই আমদানিকারকের ভাষ্য, শক্তিশালী বাজার সিন্ডিকেট করোনা আতঙ্কের সুযোগ নিয়ে এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণকারীরা এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি দ্রম্নত স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে মনে করেন তিনি। এদিকে বাজার পর্যবেক্ষকরা বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যেভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে খুচরা দোকানিদের সাজা দেওয়া হলে তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না বলে মনে করেন তারা। তবে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ভোক্তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রয়েছে। শুধু মজুতই নয়, ওএমএসে চাল বিতরণের জন্য মিলারদের চিঠি দিয়েছি। তারাও বাজারে বিক্রি করবে। আর আটা বিক্রি সব সময় চলছে, চলবে। কেউ বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।