সাধারণ রোগীর চিকিৎসায়ও অনীহা চিকিৎসকদের

ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকে কেউ কেউ অনলাইনে চিকিৎসা দিচ্ছেন সাধারণ রোগীরাও চরম বিপাকে

প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ঢাকাসহ সারাদেশে অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসামগ্রী বা পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বলতে শুধুমাত্র সার্জিক্যাল মাস্কই ভরসা। অথচ স্বল্পমূল্যের এ সামগ্রীও সব হাসপাতালে পর্যাপ্ত নেই। তাই হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক-নার্সসহ অন্য কর্মচারীদের তা নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করতে বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে সর্দিজ্বরে আক্রান্ত রোগী দূরে থাক, সাধারণ রোগীর চিকিৎসা দিতেও চিকিৎসক-নার্সরা অনীহা প্রকাশ করছেন। এরই মধ্যে অনেকে কৌশলে নিজেকে গুটিয়েও নিয়েছেন। উদ্বিগ্ন অনেক চিকিৎসক ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ স্বশরীরে উপস্থিত রোগী দেখা বাদ দিয়ে অনলাইন চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কোনোভাবে হাসপাতালে ফাইল ওয়ার্কসহ আনুষঙ্গিক কাজে ডিউটি আওয়ার পার করে ঘরে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকছেন। আর জুনিয়র চিকিৎসক যাদের স্বল্প সংখ্যক রোগী না দেখে উপায় নেই, তারা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নামকাওয়াস্তে সেবা দিয়ে রোগীদের বিদায় দিচ্ছেন। এছাড়া হাসপাতালে ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীর সেবাও চলছে অনেকটা একই তালে। গুরুতর অসুস্থ না হলে বেশির ভাগ রোগীকেই অধিকাংশ হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে সর্দি-জ্বর-কাশি ও গলা ব্যথায় আক্রান্ত রোগীর পাশাপাশি অন্য সাধারণ রোগীরাও চরম বিপাকে পড়েছেন। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দাবি, শুধু মাস্ক কেন, করোনা রোগীর চিকিৎসা সেবাদানে ব্যবহৃত বিশেষায়িত গাউন, মাস্ক, জুতা ও চশমা কোনো কিছুরই সংকট নেই। এসব নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী দেশের ছোট বড় সব হাসপাতালে তা সরবরাহ করা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে দু-এক জায়গায় এসব সামগ্রী পৌঁছাতে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে। তবে অন্য সবখানেই তা যথাসময়েই পৌঁছে গেছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ দাবির সঙ্গে বাস্তবতার যে বড় ফারাক রয়েছে তা পুরানো ঢাকার স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ মিডফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোর্শেদ রশীদ স্বাক্ষরিত নোটিশে স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। ২১ মার্চে দেওয়া ওই নোটিশে (স্মারক নং পরি/মিঃহাঃ/২০২০/৮২৮৯) বলা হয়েছে, 'অত্র স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ মিডফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকায় কর্মরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালে সেবা গ্রহণের জন্য আগত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংক্রমণ ঝুঁকি এড়ানোর জন্য প্রতিরোধ কর্মসূচি হিসেবে হাসপাতালে কর্মরত এবং সেবাকাজের সঙ্গে জড়িত সবার মাস্ক ব্যবহার করা প্রয়োজন। মজুদের স্বল্পতার জন্য হাসপাতালের তরফ হতে সবাইকে মাস্ক সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য সবাইকে নিজ উদ্যোগে মাস্ক ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করা হলো।' এই নোটিশের অনুলিপি অধ্যাপক-সহযোগী অধ্যাপক ও উপপরিচালক থেকে শুরু করে ওয়ার্ডবয়-আয়া সবাইকে পাঠানো হয়েছে। মিডফোর্ড হাসপাতালের পরিচালকের দেওয়া এ নোটিশ শনিবার দুপুরের মধ্যেই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'ভাইরাল' হয়ে পড়ে। রাজধানীর খ্যাতনামা এ হাসপাতালে সাধারণ মাস্কের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকলে দেশের জেলা-উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিরাপত্তা সরঞ্জামাদির সংকট কতখানি তা নিয়ে নেটিজনরা নানা প্রশ্ন তুলেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকরা জানান, দেশে করোনার বিস্তার বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকেই সিনিয়র চিকিৎসকরা সরাসরি চিকিৎসা সেবা থেকে নিজেদের অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছেন। তারা নিজেরা ফাইল ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকার অজুহাতে জুনিয়র চিকিৎসকদের সেদিকে বেশি ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে তারা কথা বলতে গেলে তারা তাদেরকেও যতটুকু সম্ভব কৌশলে রোগীদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। চিকিৎসকদের সেবাদানের অনাগ্রহে হাসপাতালগুলোতে সাধারণ রোগীর সংখ্যা বেশখানিকটা কমেছে বলে স্বীকার করেন তারা। যদিও সরকারি হাসপাতালগুলোর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকের দাবি, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে সাধারণ রোগীরা হাসপাতাল, ক্লিনিক, এমনকি ডাক্তারের ব্যক্তিগত চেম্বারও এড়িয়ে চলছেন। শুধু গুরুতর অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসকের কাছে আসছেন। এ কারণে খ্যাতনামা অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারেও রোগীর ভিড় কমেছে। তবে সর্দিজ্বর, শুকনো কাশি কিংবা গলাব্যথা হলে বেশির ভাগ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কায় চিকিৎসকের কাছে ছুটছেন। এ অবস্থায় এ ধরনের রোগীর ভিড় বাড়লেও অন্য রোগীর সংখ্যা কমেছে। অথচ নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকায় উদ্বিগ্ন চিকিৎসকরা এসব রোগীর চিকিৎসা দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ অবস্থায় চিকিৎসকরা অনেকেই ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা সীমিত করেছেন। কেউ কেউ শুধুমাত্র পুরানো রোগী দেখছেন। এদিকে এরইমধ্যে বেশকিছু চিকিৎসক অনলাইনে চিকিৎসা সেবা চালু করেছেন। তারা দিন ও রাতের নির্ধারিত সময় রোগীর সঙ্গে ভাইবার-ম্যাসেঞ্জর কিংবা হোটাসআপে যুক্ত হয়ে রোগীর চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ জানান, প্রবাসী অনেকে তাদের শিশু সন্তান কিংবা পরিবারের অন্য অসুস্থ সদস্য নিয়ে চিকিৎসকদের চেম্বারে আসছেন। রোগীর চিকিৎসাপত্র দেওয়ার একপর্যায়ে তাদের পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে। কোয়ারেন্টিনে না থেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মেলামেশা এবং চিকিৎসকের চেম্বারে আসার ব্যাপারে খোঁজ নিলে এদের অনেকেই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ জানাচ্ছেন, এ বিষয়ে তাদেরকে কেউ অবহিত করেনি। এমনকি দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে তাদের এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়নি। এসব কারণে চিকিৎসকরা বেশি উদ্বিগ্ন। এছাড়া পিপিই না থাকার বিষয়টি তো রয়েছেই- যোগ করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, কয়েকদিন আগে একজন ইতালিপ্রবাসী পরিচয় গোপন করে তার চেম্বারে এসে চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে তার সঙ্গীয় স্বজনের কথাবার্তায় তা প্রকাশ পায়। সর্দিকাশি ও শ্বাসকষ্টে থাকা ওই প্রবাসীকে তিনি আইইডিসিআরে যোগাযোগ করে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়ায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এ ঘটনার পর থেকে তিনি নতুন কোনো রোগী দেখছেন না বলে জানান। বিশেষজ্ঞ একাধিক চিকিৎসক বলেন, শুধু করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় পিপিই জরুরি- এমন নয়। কেননা, জ্বর-সর্দি-কাশি ও গলায় ব্যথা নিয়ে যারা ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাদের কেউ করোনায় আক্রান্ত কি না তা রোগী দেখেই শনাক্ত করার সুযোগ নেই। তাই এসব রোগীর সংস্পর্শে এসে সাধারণ চিকিৎসকরাও এ ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন। এ কারণে চিকিৎসকদের সবাইকে সতর্ক থাকা জরুরি। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সসহ সেবা সংশ্লিষ্ট সবাইকে নূ্যনতম নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি সরবরাহ করতে না পারা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার নাজুক দশা প্রমাণ করে বলে মনে করেন তারা। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. বশীর আহাম্মদ বলেন, উন্নত দেশগুলোর মতো করোনা মহামারি প্রতিরোধে দেশের হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়। এই অবস্থায় স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকে যায়। তাদের স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয় উপকরণের বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি। রাজধানীর কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে সর্দি-জ্বর-কাশি ও গলায় ব্যথায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পৃথক কর্নার করা হয়েছে। তবে সেখানে কর্মরত চিকিৎসকদেরও মাস্ক ছাড়া অন্য কোনো নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি দেওয়া হচ্ছে না। এ কারণে চিকিৎসকরা প্রায় কেউই সেখানে দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তারা অনেকেই নিজের টাকায় গাউন, জুতাসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সামগ্রী কিনে সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন। এদিকে বেশ কয়েকটি স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে সর্দিকাশির জন্য পৃথক কর্নার করা নিয়ে জুনিয়র-সিনিয়র চিকিৎসকদের মধ্যে উত্তপ্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে। হাসপাতাল থেকে উপযুক্ত পিপিই সরবরাহ করা না হলে এবং সিনিয়র চিকিৎসকরা সেখানে পালাক্রমে ডিউটি না করলে তারাও সেখানে ডিউটি করবেন না বলে জুনিয়র চিকিৎসকরা সাফ জানান দিয়েছেন।