বাস, লঞ্চ, ট্রেন বন্ধ

লকডাউনের পথে দেশ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে জনপদ

মঙ্গলবার থেকে সব জেলার সঙ্গে ঢাকার ট্রেন, বিমান ও নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সব রুটে বিমান চলাচলও বন্ধ

প্রকাশ | ২৫ মার্চ ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের সিদ্ধান্তে মঙ্গলবার থেকে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করায় নদীর মাঝে লঞ্চগুলো নোঙর করে রাখা হয়। ছবিটি বুড়িগঙ্গা নদী থেকে তোলা -পিবিএ
সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলা। মঙ্গলবার থেকে বাংলাদেশের সব জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার ট্রেন, বিমান ও নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে অভ্যন্তরীণ সব রুটে বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ খবর জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ। এর আগে রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। এরই মধ্যে যেসব ট্রেন বেইজ স্টেশন থেকে ছেড়ে এসেছে সেগুলো আবার ফিরে যাবে। সেসময় যাত্রী পরিবহণ করা হবে কি না এমন প্রশ্নে রেলমন্ত্রী বলেন, 'যদিও আমরা পরিবহণের উদ্দেশ্যে পরিচালনা করছি না, তবে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কেউ ট্রেনে উঠে বসলে সেটা ভিন্ন বিষয়।' তবে পণ্য পরিবহণের জন্য মালবাহী ট্রেনগুলো চলাচল করবে বলেও জানান তিনি। এর আগে মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে নৌপথে লঞ্চ, ছোট নৌকাসহ সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। নৌ-পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এ কথা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, যাত্রীবাহী নৌযান না চললেও পণ্যবাহী নৌযানগুলো চলাচল করবে। এর আগে সকালে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশে সব ধরনের গণপরিবহণ বৃহস্পতিবার থেকে 'লকডাউন' করা হবে। বাংলাদেশের কোন সড়কে কোন রকম যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচল করবে না। এই লকডাউন কার্যকর থাকবে পরবর্তী ১০ দিন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতেই এ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে। তবে লকডাউন উপেক্ষা করেই সোমবার ছুটি ঘোষণার পর রাজধানী ঢাকা ছেড়েছেন অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেন ও বাস স্টেশনে মানুষের ভিড়ের ছবিও ছড়িয়ে পড়ে। সোমবারই লক্ষ্ণীপুরে ফিরেছেন আল আমিন। তিনি জানান, সোমবারও সায়েদাবাদে উপচেপড়া মানুষের ভিড় ছিল। তিনি আলাদাভাবে বাস ভাড়া করে ফিরলেও তার এক বন্ধু সায়েদাবাদ বাস স্টেশনে সোমবার বিকালে গিয়ে টিকিট না পেয়ে গভীর রাতে বাসে করে বাড়ি ফেরেন। ট্রেনে করে নীলফামারী ফিরতে চেয়েছিলেন এইচ এম ফরহাদ আর তার ছোট ভাই। তারা জানান, ছুটি ঘোষণার পর পরিবারের চাপেই ঢাকা থেকে নীলফামারী ফেরার জন্য সোমবার ট্রেনের টিকিট করে রাখেন তিনি। তবে মঙ্গলবার সব ধরনের ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করার পর তাদের যাওয়াটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবে পরিবহণ বন্ধের ঘোষণা আসার আগেই লঞ্চে করে লক্ষ্ণীপুরের উদ্দেশে রওনা দেন সবুজ আলম ফিরোজ। ঢাকায় বন্দি অবস্থায় থাকতে হবে বলে গ্রামের বাড়িতে ফেরার সিদ্ধান্তের কথা জানান আলম। তিনি বলেন, বাসা থেকে বের হয়ে লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে দেখতে পান, শুধু তিনি একা নন, তার মতো আরও অনেক মানুষ বাড়ি ফিরছে। তিনি বলেন, 'মনে হচ্ছে যে, ঈদের ছুটির মতো মানুষ ফিরছে।' করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়টায় কেন বাড়ি ফিরছেন এমন প্রশ্নে আলম বলেন, বাড়ির লোকজন চিন্তা করছে বলেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। 'বুঝি, না গেলেই বেটার হতো। কারণ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে পুরো একটা গ্রামও সাফ হয়ে যেতে পারে। আমি বুঝি। কিন্তু মা যেতে বলেছেন আর মনও মানছে না'- বলেন তিনি। এদিকে মঙ্গলবারও নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে গণপরিবহণ ব্যবহারে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। ছুটি পেয়ে বাসে করে মঙ্গলবার রাতে গ্রামের বাড়ি শেরপুরে ফিরেছেন গৃহকর্মী শাহিদা বেগম। তিনি জানান, রোগের কথা জানেন তিনি। তবে ঢাকায় পরিচিত কেউ না থাকায় সংকটের মুহূর্তে গ্রামেই ফিরে যাচ্ছেন তিনি। 'সবাই যাইতেছে। যে বাসায় থাকি, তার সব কিছু খালি হইয়া যাইতেছে। একলা কী করুম। তাই যাইতেছি'- তিনি বলেন। 'দেশ-গেরামে তো মা-বাপ-ভাই-বোন সবাই আছে। এই খানে তো কিছু হইলে কেউ কাউরে ধরে না, কাছে আসব না। ওইখানে তো কেউ ডরায় না, তাই যাইতেছি।' ঝুঁকি কতটা বাড়ছে? আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, এমন অবস্থায় ঝুঁকি তো কিছুটা থাকেই। তার মতে, সংক্রমণের হার কম থাকলে ঝুঁকিও তেমন একটা থাকে না। তবে সংক্রমণের হারটা বেশি থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। 'কিন্তু আমরা তো আসলে জানতে পারছি না যে, আক্রান্তের হারটা কেমন'- তিনি বলেন। ভ্রমণ করলে সংক্রামক রোগের ঝুঁকি এমনিতেই বাড়ে বলে জানান তিনি। আর এর কারণেই আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়। মানুষ যে গ্রামে ফিরছে এতে করে মিক্সিং হওয়ার একটা শঙ্কা আছে। অর্থাৎ গ্রাম থেকে সংক্রমণ শহরে আসতে পারে আবার শহর থেকেও গ্রামে যেতে পারে। আজ থেকে বিমান, ট্রেন ও নৌযান চলাচল সারাদেশে বন্ধ থাকলেও সড়ক পরিবহণ অর্থাৎ যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ হবে বৃহস্পতিবার থেকে। আর ২৬ তারিখ থেকে ছুটি ঘোষণা হওয়ায় এই মাঝের সময়টাতে মানুষ গ্রামে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায়। এমন সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী কি না এমন প্রশ্নে মিস্টার রহমান বলেন, সেক্ষেত্রে বলতে হবে যে, সরকারের সিদ্ধান্তে কৌশলগত ত্রম্নটি ছিল। 'সেক্ষেত্রে আমি বলব স্ট্রাটেজিটা প্রোপার হয়নি'- তিনি বলেন।