করোনাভাইরাস আতঙ্ক

ঘরে থাকার 'যুদ্ধে' স্থবির জীবন

সরকার ১০ দিনের ছুটি দিয়ে জনগণকে ঘরে থাকতে বললেও সারাদেশ কার্যত 'লকডাউন' হয়ে গেছে। দেশজুড়েই অবরুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে

প্রকাশ | ২৭ মার্চ ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
সব ধরনের গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় ফাঁকা রাজধানীর রাজপথ। ছবিটি বৃহস্পতিবার নিউমার্কেট এলাকা থেকে তোলা -যাযাদি
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অফিসপাড়ায় যানবাহন ও জনমানুষের আনাগোনা কিছুটা কম থাকলেও রাজধানীর প্রতিটি মার্কেট, বিপণিবিতান ও বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে জমে ওঠে সর্বস্তরের মানুষের ভিড়। সেখানকার পার্কিং লটে জায়গা পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সকালের দিকে রাজধানীর রাস্তায় যান চলাচল কিছুটা কম থাকলেও দুপুরের পর গোটা ঢাকা পরিণত হয় যানজটের শহরে। অথচ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দিনভর যানবাহন দূরে থাক, কোথাও জনপ্রাণীর কোনো দেখা মেলেনি। সারি সারি দোকানের শাটার নামানো, মার্কেটগুলোর প্রধান গেটে ঝুলছে বিশাল তালা। আন্তঃজেলা ও সিটি সার্ভিসের শত শত বাস-মিনিবাস সারি সারি দাঁড় করানো রয়েছে রাজধানীর বাসটার্মিনালগুলোতে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালেও যাত্রীবাহী লঞ্চ নেই; নেই যাত্রীও। রেলস্টেশনগুলোতে জনমানবশূন্য ভূতুরে পরিবেশ। রাজধানীর যেসব সড়কে কর্মদিবস কিংবা ছুটির দিন নিত্য যানজট লেগেই থাকত, সেখানে সিএনজি অটোরিকশা কিংবা সাধারণ রিকশারও দেখা নেই। সব রাস্তাই যেন হয়ে ওঠেছে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলার মাঠ।র্ যাব-পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল গাড়ি ছাড়া রাস্তাঘাটে কোথাও কোনো যানবাহনের দেখা মেলেনি। হাতেগোনা সামান্য দুই-চার তরুণ কিংবা যুবক অযথা ঘোরাঘুরি করতে রাস্তায় বের হলেও তাদের দেখামাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রীতিমতো ধাওয়া দিয়ে তাদের ঘরে তুলে দিয়েছে। শুধু রাজধানীতে ঢাকায় নয়, গোটা দেশের সবখানেই একই ধরনের ছবি। সাড়ে ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার একটি দেশে সব মানুষকে যেন রাস্তাঘাট থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, মুছে ফেলা হয়েছে স্বাভাবিক জনজীবনের প্রতিটি ছোটখাটো চিহ্ন। মরণব্যাধি করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় ১০ দিনের অঘোষিত লকডাউনে এভাবেই স্তব্ধ গোটা দেশ। এমনকি সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কোথাও কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। এদিকে ওষুধপত্রের দোকান, হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া সব দোকানপাট, অফিস-আদালত, যানবাহন একসঙ্গে বন্ধ রাখায় চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে অতি জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া সাধারণ মানুষকে। যদিও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সবাই তা অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছে। এদিকে ভোর থেকেই নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ের্ যাব ও পুলিশ অপ্রয়োজনে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা মানুষজনকে ঘরে ফিরিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া জনমানবশূন্য রাস্তাঘাটে দুর্বৃত্তরা যেন কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটাতে না পারে, এ জন্য টানা টহল দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের সহায়তা করতে নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় সেনাবাহিনীকেও টহল দিতে দেখা গেছে। জরুরি সেবা সংস্থার লোকজন, সংবাদকর্মী কিংবা যারা বিশেষ প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া সাধারণ মানুষ নগরীর এই সুনশান চিত্র দেখে অনেকেই ঘাবড়ে গেছেন। তারা অনেকে জানিয়েছেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার ১০ দিনের ছুটি দিয়ে জনগণকে ঘরে থাকতে বললেও সারাদেশ কার্যত 'লকডাউন' হয়ে গেছে। পুরো দেশজুড়েই অবরুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত ২৫ মার্চ জাতীর উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'করোনাভাইরাস মোকাবিলাও একটা যুদ্ধ, যে যুদ্ধে মানুষের দায়িত্ব ঘরে থাকা। তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'আপনারা যে যেখানে আছেন, সেখানেই অবস্থান করুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সবাই যার যার ঘরে থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন। আমরা সবার প্রচেষ্টায় এই যুদ্ধে জয়ী হব।' সকালে সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ফুলবাড়িয়া, মহাখালী ও গাবতলী বাসটার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, এসব টার্মিনাল থেকে কোনো বাস ছেড়ে না যাওয়ায় পরিবহণ শ্রমিকরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ এরই মধ্যে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস-মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জানান, সকাল থেকে একটি বাসও ছাড়া হয়নি। রাস্তাঘাটে কোনো লোকজন নেই। এমন পরিবেশ আর কখনো হয়নি। একই অবস্থা ছিল গাবতলী টার্মিনালেও। বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মারুফ তালুকদার জানান, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা একটি বাসও ছাড়েনি। একই চিত্র দেখা গেছে ফুলবাড়িয়া, মহাখালীসহ রাজধানীর অন্যান্য পরিবহণ টার্মিনালগুলোতে। চুয়াডাঙ্গা : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গণপরিবহণ ও বেশিরভাগ ব্যবসাকেন্দ্র বন্ধ থাকায় অঘোষিত লকডাউনে পরিণত হয়েছে চুয়াডাঙ্গা শহর। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপালস্নার কোনো রুটে বাস চলাচল করতে দেখা যায়নি। ছোটখাট যান চলাচলও ছিল সীমিত আকারে। মাঝে মাঝে পণ্যবাহী ও জরুরি কাজে নিয়োজিত কিছু পরিবহণ চলাচল করতে দেখা গেছে। শহরের সবকটি বাস কাউন্টার ও বাসটার্মিনাল ছিল প্রাণহীন। রাস্তাঘাট ছিল অনেকটা জনমানবহীন। এদিকে, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে জেলার সবগুলো বাজারেই ওষুধ ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দোকান ছাড়া সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এসব কারণে চুয়াডাঙ্গা শহর জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাঠে ছিল। শেরপুর : বুধবার রাত থেকে দূরপালস্নার যানবাহন এবং সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ থাকায় শেরপুর জেলা শহর এখন পুরোপুরি লকডাউনে রয়েছে। একান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না। শহরের রাস্তাঘাট রয়েছে অনেকটা নব্বই দশকের হরতালের মতো ফাঁকা। এমনকি জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত থাকলেও সেখানেও রোগীর সংখ্যা খুবই কম। প্রতিদিন যেখানে প্রায় তিন শতাধিক রোগী ভর্তি ও চিকিৎসা নিলেও বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছে মাত্র ২০ জন। ফলে হাসপাতালের অধিকাংশ বেড ছিল ফাঁকা। জেলার আইনশৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জনগণকে সচেতন করতে এবং লকডাউন মেনে ঘরে অবস্থান করার জন্য প্রচারাভিযান অব্যাহত রেখেছে। ধর্মপাশা : করোনাভাইরাস প্রতিরোধে  সামাজিক দূরত্ব ও সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে  সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার  জনগণকে সচেতন করতে  উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার পাড়া-মহলস্নার ব্যস্ততম সড়কে পিকআপ ভ্যানসহ মোটরসাইকেলযোগে প্রচারণা চালিয়েছে ধর্মপাশা ও মধ্যনগর থানা পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান ছাড়া অন্যান্য বিপণিবিতান বন্ধ ছিল। রাস্তাঘাটেও লোকজন ছিল খুবই কম। পুলিশ সদস্যদের টহলের খবরে মানুষ ঘর থেকে বের হয়নি বললেই চলে। কালিয়াকৈর (গাজীপুর) : কালিয়াকৈর নোভেল করোনাভাইরাসের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরধার করতে হাসপাতাল, ফার্মেসি, চাল ও কাঁচা-বাজারের দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ ছিল। পিকনিক স্পটগুলোকে অলিখিত লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষ জরুরি কাজ ছাড়া যাতে বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি না করে, এ জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব জায়গায় নিয়মিত মাইকিং করে হচ্ছে। আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) : প্রশাসনের প্রচার ও তৎপরতায় স্থানীয় মানুষ স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হওয়ায় সরব আনোয়ারা এখন নীরব। বাঁশখালী, পেকুয়া, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়ার যাত্রীদের আনোয়ারার পিএবি সড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত, চায়না অর্থনৈতিক জোন- কর্ণফুলী টানেলের বিশাল কর্মযজ্ঞ, এমনকি সেখানকার কারখানার কর্মতৎপরতা থমকে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে সব ধরনের যান চলাচল। এতে গোটা আনোয়ারা অনেকটাই লকডাউনে পরিণত হয়েছে। শেরপুর (বগুড়া): বগুড়ার শেরপুরে বৃহস্পতিবার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে করোনা প্রতিরোধে লকডাউনবিধি অমান্য করায় প্রায় ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। উপজেলার কলেজ রোড, মহিপুর বাজার, গাড়িদহ বাজার, বাস্টান্ড এলাকা, ধুনট মোড়, রণবীরবালা ঘাটপাড় এলাকা বন মরিচা, টুনিপাড়া, শেরুয়া বটতলা, কেলস্না, বাগড়া, নন্দীগ্রাম রোড ও দুবলাগাড়ী এলাকায় বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়ায় এবং রাস্তায় অযথা ঘোরাঘুরি করায় কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়। ঘিওর (মানিকগঞ্জ) : করোনাভাইরাসে এক ব্যক্তির (৪৮) মৃতু্য হয়েছে- এমন সন্দেহে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার একটি গ্রামকে লকডাউন ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আইরিন আক্তার জানান, ওই ব্যক্তি সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর সে হোম কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। তবে তিনি কি রোগে মারা গেছেন, তা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে তাদের পরিবারের সবাইকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। পাবনা : করোনা আক্রান্ত সন্দেহে পাবনার ঈশ্বরদীর নারিচা এলাকায় রাশিয়ানদের ভাড়াকৃত 'হাউস-২' লকডাউন করা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎ প্রকল্পে কর্মরত করোনা সন্দেহভাজন বেলারুশিয়ান নাগরিককে বুধবার রাত ১০টার পর ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই বাড়িতে প্রকল্পে কর্মরত ১৫-১৬ জন বিদেশি নাগরিক বসবাস করছে বলে জানা গেছে। বাড়িটির গেট তালাবদ্ধ করে রাতেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার লকডাউনের ঘটনা নিশ্চিত করেছেন। বাসাইল (টাঙ্গাইল) : টাঙ্গাইলের বাসাইলে তিনটি পরিবারকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর গ্রামের লুৎফর রহমান, ফজলুর রহমান ও আতোয়ার রহমানের তিনটি পরিবারকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ ফজলে এলাহী এই ঘোষণা করেন। ওই পরিবারে ১২ জন সদস্য রয়েছে। জানা যায়, মিরপুরে লকডাউন হওয়া একটি বাড়ি থেকে জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যক্তি তার স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে এসে তার শ্বশুর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর গ্রামের লুৎফর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। গত পাঁচদিন যাবৎ তিনি ওই বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।