বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে করোনায় আক্রান্তের তুলনায় মৃতের হার বেশি

সাখাওয়াত হোসেন
  ২৭ মার্চ ২০২০, ০০:০০

দেশে গত ৮ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ১৯ দিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী হিসেবে ৪৪ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৮ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ৯ দিনে ৫ জন মারা গেছে। এ হিসাবে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশে করোনায় মৃতের হার ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী সারা বিশ্বে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হিসাবে মৃতের হার মাত্র ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

করোনায় আক্রান্ত বিশ্বের ১৮৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ইতালিতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মৃতের হার ১০ দশমিক ০৮ শতাংশ। এ রোগের উৎপত্তিস্থল চীনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক হলেও মৃতের হার মাত্র ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। এ অবস্থায় বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কম হলেও সেখানে মৃতের হার এতটা বেশি কেন তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। কৌশলগত কোনো কারণে সরকার প্রকৃত রোগীর সংখ্যা গোপন করেছে কিনা তা নিয়েও অনেকে সন্দেহ পোষণ করেছে।

যদিও স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা এ সন্দেহ একেবারেই অমূলক বলে মনে করছে। তাদের ভাষ্য, করোনায় আক্রান্ত রোগীর তথ্য গোপন করার কোনো সুযোগ কারো নেই। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কিংবা তার পরিবারও এ তথ্য গোপন করতে চাইলেও তা প্রতিবেশি ও চিকিৎসকদের মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, প্রাণঘাতী এ রোগ শনাক্তকরণ কিট পর্যাপ্ত না থাকায় সন্দেহভাজন অনেক রোগীকে পরীক্ষা করা হয়নি। এক্ষেত্রে সর্দি-জ্বর ও গলাব্যথায় আক্রান্ত শুধু বিদেশফেরত গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তাদের শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেলে পরবর্তীতে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে যারা করোনার নানা উপসর্গ নিয়ে জটিল অবস্থায় রয়েছে তাদের পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ বিদেশফেরত ব্যক্তিরা তার ঘনিষ্ঠজনদের পাশাপাশি আরও বিপুলসংখ্যক ব্যক্তির সঙ্গে নানাভাবে মেলামেশা করেছেন। এদের মধ্যে কেউ অসুস্থ কিনা যা তাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তাই আপাতদৃষ্টিতে দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা কম মনে হলেও, বাস্তবিকভাবে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি, যা

শনাক্ত না হওয়ায় মৃতের হার আপাতদৃষ্টিতে বেশি মনে হচ্ছে বলে করেন তারা।

তবে অনেকের ধারণা, শুধু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণের ক্ষেত্রেই নয়, এ রোগের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রেও দেশ যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি (পিপিই) প্রদান, আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরি, আইসিইউ সেবা দান ও চিকিৎসক-নার্সদের এ ব্যাপারে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি রয়েছে। যে কারণে করোনার উপসর্গ নিয়ে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে কিংবা চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে হাজির হলে ডাক্তার-নার্সদের পাশাপাশি অন্য রোগীরাও ছুটে পালাচ্ছে। যে কারণে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন সর্দি-জ্বর ও গলাব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও সেখানে তাদের বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়েছে। যদিও এসব মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনের করোনা পরীক্ষা করে 'নেগেটিভ' ফল পাওয়া গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আপডেট তথ্য অনুযায়ী, ২৬ মার্চ পর্যন্ত চীনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮১ হাজার ২৮৫ জন, মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ২৮৭ জন। অর্থাৎ মৃতের হার ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৪ হাজার ৩৮৬ জন; মৃতের সংখ্যা ৭ হাজার ৫০৩ জন; মৃতের হার ১০ দশমিক ০৮ শতাংশ। একইভাবে করোনায় আক্রান্ত রোগীর দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত ৬৮ হাজার ৫৭৩ জন; মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৩৬ জন; মৃতু্যর হার ১ দশমিক ৫১ শতাংশ।

একইভাবে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম দশে থাকা স্পেনে মৃতের হার ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ; জার্মানিতে দশমিক ৫৬ শতাংশ; ইরানে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ; ফ্রান্সে ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ; যুক্তরাজ্যে (ইউকে) ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ; দক্ষিণ কোরিয়ায় ০ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

এছাড়া করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী নেদারল্যান্ডে মৃতের হার ৫ দশমিক ৫৫; কানাডায় ১ দশমিক ০৫; সুইডেনে ২ দশমিক ৪৫; মালয়েশিয়ায় ১ দশমিক ১৩; জাপানে ৩ দশমিক ৪৪; পাকিস্তানে ০ দশমিক ৭২; থাইল্যান্ডে ০ দশমিক ৩৮; ভারতে ১ দশমিক ৮৭; সিঙ্গাপুরে ০ দশমিক ৩১; হংকং-এ ০ দশমিক ৮৮; ইরাকে ৮ দশমিক ৩৮; তাইওয়ানে ০ দশমিক ৭৯ ও আফগানিস্তানে ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ মৃতু্য হয়েছে।

অন্যদিকে সৌদ আরব, সাউথ আফ্রিকা, কাতার, কুয়েত, আরমেনিয়া ও কিউবাসহ আরও বেশকিছু দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাংলাদেশের সমপর্যায়ে কিংবা আরও অধিক হলেও সেখানে মৃতের সংখ্যা এখনো শূন্যের কোঠায় রয়েছে।

দেশের স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দাবি, চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর দীর্ঘ সময় পেলেও বাংলাদেশ এ ব্যাপারে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়নি। এ কারণে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস মোকাবিলায় প্রথমদিকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। তবে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় মৃতের হার কমবে বলে আশা করেন তারা।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ করোনা মোকাবিলায় সময়মতো সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন। যদিও দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তার এ দাবির যথাযথ সত্যতা মেলেনি।

চট্টগ্রামের ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি)-এর একটি সূত্র জানায়, ছয় দিন আগে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে করোনাভাইরাস শনাক্তকারী কিট পৌঁছানোর আশ্বাস দিলেও ৭ দিনেও তা পৌঁছেনি। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি মিয়া মঙ্গলবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, বিআইটিআইডি থেকে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের একজন ডাক্তার এবং দুইজন টেকনিশিয়ানকে প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। তাদের শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রামের ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালটিকে পুরোপুরিভাবে করোনা রোগীদের জন্য প্রস্তুত করার ঘোষণা দয়া হলেও এখন পর্যন্ত সেখানে মাত্র ১০০ বেড প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে।

স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টরা জানান, এ চিত্র শুধু চট্টগ্রামেই নয়, দেশের প্রতিটি জেলাতেই করোনার প্রস্তুতি এখন সম্পূর্ণ হয়নি। এ কারণে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা পেতে যথেষ্ট বিলম্ব হচ্ছে। এ পরিস্থিতির দ্রম্নত উত্তোরণ ঘটানো সম্ভব না হলে মৃতের হার কমিয়ে আনা অসম্ভব বলে মনে করেন তারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<94286 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1