করোনা : বাংলাদেশের সামনে চার চ্যালেঞ্জ

প্রকাশ | ২৮ মার্চ ২০২০, ০০:০০

সোহেল হায়দার চৌধুরী
বিশ্বব্যাপী প্রাণহরণকারী ও আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কোভিড-১৯ ভাইরাস তার থাবা বিস্তার করে চলেছে অব্যাহতভাবে। করোনার বিস্তার থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে সরকার কর্তৃক সামাজিক দূরত্ববিধি নিশ্চিতের কঠোর পদক্ষেপের মাঝেও সীমাহীন আতঙ্ক বিরাজ করছে। সরকারি সূত্র আশঙ্কা করছে কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ করোনাভাইরাস। এই পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রম্নত শনাক্ত, তাদেরকে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার পাশাপাশি বিভিন্ন স্তরে ব্যাপকহারে নমুনা সংগ্রহ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যবিদরা। চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের নির্দেশনা ও প্রশাসনের কঠোরতার কারণে সামাজিক দূরত্ববিধি শতভাগ সফল না হলেও পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। এখন এ সতর্কতার মাত্রা ধারাবাহিকভাবে বাড়ানোর জন্য নানা উপায় বের করতে হবে। প্রয়োজন হলে ছুটির পরিমাণও বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। তারা মনে করছেন, আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকা লোকজনকে দ্রম্নততার সঙ্গে শনাক্ত করাও অত্যন্ত জরুরি। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো সব স্তরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিধি বাড়ানো। একই সঙ্গে তারা এই পরিস্থিতিতে গুজব ঠেকানোর বিষয়েও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন। এরই মাঝে করোনাভাইরাস কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে বলে আশঙ্কা করছেন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসকরা। এর সত্যতা পাওয়া গেছে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রেস ব্রিফিংয়ে। আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গতকাল বলেছেন, করোনাভাইরাস সীমিত পর্যায়ে কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এখনো তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েনি। সরকারি সূত্র নিশ্চিত করেছে, দেশে নতুন করে আরও ৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে দুজন চিকিৎসক। ফলে দেশে সরকারি হিসাবমতে, এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৮-এ। গতকাল শুক্রবার (২৭ মার্চ) বেলা ১১টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা অনলাইন ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১০২৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, প্রথমদিকে শুধুমাত্র যারা বিদেশ থেকে এসেছেন বা বিদেশফেরতদের সংস্পর্শে এসেছেন এমন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা হতো। এখন যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি এবং দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভুগছেন তাদের মধ্যে কারও লক্ষণ দেখা দিলে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এছাড়া যাদের নিউমোনিয়া ছিল বা কী কারণে নিউমোনিয়া হচ্ছে তা দেখার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এছাড়াও যারা বিভিন্ন পেশার লোকজনদের সংস্পর্শে আসেন এমন পেশাজীবীদের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সতর্কতা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের পাশাপাশি দেশের সব অঞ্চলে আক্রান্তদের দ্রম্নত শনাক্ত করে চিকিৎসা দেওয়া না গেলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। সেজন্য তাৎক্ষণিক নমুনা সংগ্রহ, রিপোর্ট সংগ্রহ ও চিকিৎসার উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রসার ঘটানো জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব হটলাইন চালু করা হয়েছে, সেগুলোতে যারা কল করবেন তাদের কথা প্রয়োজনে রেকর্ড করা দরকার। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেসব কথা পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে সন্দেহভাজনদের ডেকে পরীক্ষা করতে পারেন। জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ মুন্সী যায়যায়দিনকে বলেন, এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত টেস্টের ব্যবস্থা করা দরকার। এখন পর্যন্ত যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাদের সংস্পর্শে যারা গেছেন এবং ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের টেস্ট করা হচ্ছে। এর পরিধি বাড়ানো দরকার। এখন থেকে যাদের সামান্যতম লক্ষণ আছে তাদেরকেও টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়া দরকার। টেস্ট বা পরীক্ষায় পজিটিভ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে চলাফেরা করেছেন এমন ব্যক্তিদেরও চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতায় আনা দরকার। অধ্যাপক ডা. সাইফ মুন্সী বলেন, ভারতে ৬২ স্থানে, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০০ স্থানে টেস্ট হচ্ছে। আমাদের টেস্ট বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিধি অচিরেই বাড়ানো দরকার। সময় দ্রম্নত বয়ে যাচ্ছে। কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে বলে আমরা যে আশঙ্কা করছি তা দ্রম্নত ঠেকানো দরকার। নতুবা এই মহামারি বাংলাদেশকে কঠিন হতাশা ও শোকের মধ্যে ফেলে দেবে। তিনি সামাজিক গুজব বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানান। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব ও ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজের মতে, এই মুহূর্তে করোনা আক্রান্তদের সঠিকভাবে শনাক্ত ও তাদের সঙ্গে চলাফেরা করেছে এমন যারা রয়েছেন তাদেরকে খুঁজে বের করা দরকার। সেইসঙ্গে 'জিরো টলারেন্স' নীতিতে বিদেশফেরত প্রত্যেককে শনাক্ত করে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন বা প্রয়োজনমতো চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতায় আনা উচিত। তিনি বলেন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের যে চ্যালেঞ্জ সরকার হাতে নিয়েছিল উলেস্নখযোগ্য হারে সফল। এর ফলে করোনার বিস্তার হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তবে নানা পর্যায়ে আরও জোরালো কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, কমিউনিটি পর্যায়ে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে যাবার আগে ভাইরাসটির বিস্তার রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেজন্য ব্যাপকহারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। রাজধানীর পাশাপাশি পুরো দেশেই চিকিৎসাব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। হটলাইনে যারা কল করবেন প্রয়োজনে তাদের কথা রেকর্ড করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পর্যালোচনা করে সন্দেহভাজন মনে করলে ডেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন। সেইসঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তি বা রোগীকে দ্রম্নততার সঙ্গে হাসপাতালে বা চিকিৎসাকেন্দ্রে আনার সরকারি ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি থাকা দরকার। পাশাপাশি গুজব বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।