সুরক্ষা পোশাকের অভাবে ভীত অ্যাম্বুলেন্স চালকরা

প্রকাশ | ৩১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

জাহিদ হাসান
দেশের অ্যাম্বুলেন্স চালক ও তাদের সহকারীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক বা পিপিই না থাকায় করোনা আতঙ্কে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন অনেকেই। এতে দেশজুড়ে অ্যাম্বুলেন্স সংকট দেখা দিয়েছে। এতে জরুরি প্রয়োজনেও অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। অন্যান্য গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে অ্যাম্বুলেন্স সেবা সচল রাখতে চালক ও সহকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ৬৪টি জেলায় প্রায় ৫ হাজারের বেশি অ্যাম্বুলেন্স চালক ও সহকারী রোগী পরিবহণের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। যারা নিয়মিতভাবে রোগীদের হাসপাতালে আনা-নেওয়া করে থাকেন। তবে সম্প্রতি দেশব্যাপী করোনাভাইরাস আতঙ্কের কারণে অনেক চালক রোগী পরিবহণ থেকে বিরত থাকছেন। এ কারণে প্রতিদিন অসংখ্য রোগীর হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও তাৎক্ষণিক পরিবহণ সংকটে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সরেজমিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে ও বিভিন্ন এলাকার রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অ্যাম্বুলেন্স বিড়ম্বনায় পড়তে দেখা গেছে। তারা বলেছেন, মূলত করোনাভাইরাস আতঙ্কের কারণে অধিকাংশ চালক রোগী পরিবহণ থেকে বিরত রয়েছেন। অন্যদিকে দেশজুড়ে সব ধরনের গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছাতে রোগীদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। ইউরিন সমস্যা নিয়ে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি থাকা ময়েন \হআলী (৫০) নামের এক রোগীকে দ্রম্নত অস্ত্রোপচারের জন্য রাজধানীর জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে নেওয়ার পরামর্শ দেন স্থানীয় চিকিৎসকরা। তবে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা চলায় অসুস্থ ময়েন আলীকে নিয়ে কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় আসতে রাজি হয়নি। বগুড়ার ধুনট উপজেলার মাসুদ রানা নামে এক ব্যক্তি সর্দি-কাশি ও জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে প্রথমেই তাকে পরিবহণ সংকটে পড়তে হয়। অনেক চেষ্টার পর একপর্যায়ে হাসপাতালে পৌঁছালেও হাসপাতালে মারা যান তিনি। এদিকে হাসপতালে রোগী উপস্থিতির হার কম হওয়ার ব্যাপারে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনা আতঙ্কের কারণে গত শনিবার হাসপাতালটির বহির্বিভাগে মাত্র ১৪ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। একইভাবে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থপেডিকস ও পুনর্বাসনকেন্দ্র এবং নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কমছে বলে জানা গেছে। তবে হাসপাতাল-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে পরিবহণ সংকটের কারণেই রোগীরা যথাসময়ে হাসপতালে না আসতে পারায় এমনটা হয়েছে। আবার অনেক রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি যেতে চাইলেও পরিবহণ সংকটে যেতে পারছেন না। তবে বিষয়টি সম্পর্কে অ্যাম্বুলেন্স চালক ও সহকারীরা বলছেন, দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস আতঙ্কে সবশ্রেণির পেশাজীবী ঘরমুখী হয়েছে। কিন্তু তারা রোগীদের সেবায় মাঠে থাকলেও মরণব্যাধি করোনাভাইরাস থেকে তাদের সুরক্ষায় মালিকরা কোনো ধরনের সহায়তা দিচ্ছেন না। ফলে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী পরিবহণে তারা নিজেরাও ঝুঁকিতে রয়েছেন। জনস্বাস্থ্যবিদরা যায়যায়দিনকে বলেছেন, রোগী পরিবহণের কাজে নিয়োজিত একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক ও সহকারী স্বাস্থ্যসেবার অবিচ্ছেদ অংশ। কারণ চিকিৎসক-নার্সদের মতো তাদেরও অসুস্থ মানুষের সংস্পর্শে থাকতে হয়ে। ফলে বিভিন্ন ধরনের ছোঁয়াছে রোগে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাছাড়া একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক ডাক্তারদের মতো শিক্ষিত না হওয়ায় স্বাস্থ্য সচেতন নয়। এজন্য চিকিৎসক-নার্সদের মতো সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিতে তাদের গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। আদিবা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের চালক ও ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত শেখ আব্দুর রশিদ নয়ন যায়যায়দিনকে অভিযোগ করেন, দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে জানার পর মালিক পক্ষ থেকে চালকদের একটি করে সাধরণ মাস্ক ও হ্যান্ডরাব দিয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। অথচ তারা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সংক্রমণ ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী পরিবহণ করে থাকেন। এ কারণে অন্যান্য সাধারণ মানুষের চেয়ে তারা বেশি ভয়ে আছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে অবস্থানরত আরেক অ্যাম্বুলেন্স চালক বলেন, তারা ঝুঁকিপূর্ণ রোগী পরিবহণ করলেও তাদের সেফটির জন্য কোনো ধরনের সুরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়া হয়নি। ফলে অনেক চালক করোনা আতঙ্কে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তাছাড়া অনেক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি নিতে না চাওয়ায় চালকদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমব্যয় সমিতির সভাপতি মো. আলমগীর হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, সমিতির তত্ত্বাবধানে সারাদেশে ১ হাজার ৩৭ জন মালিকের ২ হাজার ৮০টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এসব অ্যাম্বুলেন্সের জন্য কয়েক হাজার চালক ও হেলপার আছেন। বর্তমানে করোনাভাইরাসের মতো জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যসম্মত হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, হ্যান্ডগস্নাভস, বুটজুতা, বিশেষ গাউন ও চশমাসহ অন্যান্য পিপিই প্রয়োজন। এ জন্য প্রায় ১০ দিন আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর সুরক্ষা সরঞ্জাম চেয়ে দরখাস্ত করা হয়েছে। অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ বিদেশ থেকে আমদানি সাপেক্ষে ৫০০ সেট পিপিই দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এছাড়া একজন ব্যবসায়ী (সিআইপি) ৩০০ সেট পিপিই দিতে চেয়েছে। আর এগুলো চালকদের মধ্যে দ্রম্নত সরবরাহ করতে পারলে আতঙ্ক দূর হবে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ এগিয়ে এলে অনেক উপকার হবে বলে তিনি জানান।