করোনায় চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক

প্রকাশ | ৩১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ও নাজুক প্রস্তুতি নিয়ে দেশের চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা কীভাবে এ মরণব্যাধি মোকাবিলা করবেন তা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ-আতঙ্ক হুহু করে বাড়ছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনার উপসর্গ নিয়ে বিনা চিকিৎসায় একের পর এক সন্দেহভাজন রোগীর মৃতু্য এবং অধিকাংশ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকৃতির খবর বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে নানা ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া জেলা শহরগুলোতে করোনা চিকিৎসায় চিকিৎসক-নার্সদের পলায়নপর মনোভাবের সংবাদ প্রকাশ পাওয়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে করোনার চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য প্রশাসনের দাবি, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। দেশের কোথাও বিনা চিকিৎসায় কোনো রোগীও মারা যায়নি। চিকিৎসক-নার্সদের সুরক্ষায় পর্যাপ্ত পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকু্যইপমেন্ট (পিপিই) মজুদ রয়েছে। সুতরাং করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতে চিকিৎসক-নার্সদের ভীতি বা অনীহা প্রকাশ করার কথা নয়। তবে প্রশাসনের এ দাবির সঙ্গে চিকিৎসকদের বক্তব্যের যে বিশাল ফারাক রয়েছে, তা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, কুয়েত মৈত্রী, মিরপুর মেটারনিটি, সাজিদা ফাউন্ডেশন, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার (জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল) মহানগর জেনারেল, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল কমলাপুর, কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ (শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট) রাজধানীতেই যে দশটি হাসপাতাল করোনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছে, সেখানে সবচেয়ে জরুরি ভেন্টিলেটরের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বেশ কয়েকটি হাসপাতালে অভিজ্ঞ চিকিৎসক নেই বললেই চলে। কবে নাগাদ সেখানে অভিজ্ঞ চিকিৎসক নতুন করে পদায়ন করা হবে- তা এখনো খোদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরই জানা নেই। এ অবস্থায় সেখানে করোনার মতো প্রাণঘাতী জটিল রোগের কতটা সুষ্ঠু চিকিৎসা হবে- তা নিয়ে খোদ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরাই সংশয় প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-বিএমএ মহাসচিব ড. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, 'করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। রোগী বাড়লে তাদের প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করা, পর্যাপ্ত পরীক্ষার কিট মজুদ রাখা, সংকট কাটানোর সক্ষমতা অর্জন- এসব ক্ষেত্রে কোনো প্রস্তুতি নেই স্বাস্থ্য খাতের।' স্বাস্থ্য বিভাগের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'তারা বলছে পর্যাপ্ত পিপি আছে, কিট মজুদ আছে। কিন্তু পরিমাণটা তারা বলতে পারছে না। তাদের এ ধরনের আচরণ সন্দেহজনক।' করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কী কী প্রয়োজন আর কতটা ঘাটতি আছে, সেগুলো পরিষ্কার করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি। দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক জানান, বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনের কারণে জ্বর বা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত অনেক রোগীকে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে সেখানেও পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা না থাকায় অনেক রোগী বিনা চিকিৎসায় আরও মুমূর্ষু হয়ে পড়ছেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে চিকিৎসা করছেন না বলে স্বীকার করেন তারা। ওই চিকিৎসকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারের উদাসীনতার কারণে তিন মাস ধরে পৃথিবীর যত দেশে করোনাভাইরাস স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ ঘটেছে, সেসব দেশের মানুষকে অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছে। অথচ হাসপাতালে এ প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটরসহ আনুষঙ্গিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা হয়নি। দেশে এ রোগের প্রকোপ বাড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। এদিকে, সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জ্বর-সর্দি-কাশি ও গলা ব্যথার মতো উপসর্গ নিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ আইইডিসিআরে করোনা পরীক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে তারা রাজধানীর খ্যাতনামা সরকারি হাসপাতালগুলোতেও কোনো চিকিৎসা পাচ্ছে না। বরং কোথাও কোথাও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। রোববার মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা আজমল শেখ এ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেন, জ্বর ও শুকনো কাশি নিয়ে তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে তিনি সেখানে কোনো চিকিৎসা পাননি। এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাজমুল হাসান বলেন, 'আমাদের এখানে একটি কর্নার করা হয়েছে যেখানে সর্দি-কাশি-জ্বর নিয়ে আসা রোগী দেখা হয়। রোগীকে প্রাথমিকভাবে দেখে যদি মনে হয় করোনা তাহলে অন্য জায়গায় রেফার করি। এখানে কর্মরত ডাক্তার, নার্স ও অন্য কর্মীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এটা করা হয়েছে।' রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, করোনার উপসর্গ নিয়ে কেউ হাসপাতালে এলে গোটা ক্যাম্পাসের চিকিৎসক-নার্সদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসা দেওয়া দূরে থাক, তাকে কীভাবে দ্রম্নত হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া যায় সবাই মিলে সে চেষ্টা করছেন। এ ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কেউ কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। এদিকে, সরকারের স্বাস্থ্য প্রশাসন 'করোনা মোকাবিলায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি' থাকার দাবি করলেও বাস্তবে তা কতটা যথেষ্ট তা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট চিত্র পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর অবস্থার অবনতি হলে তার জন্য আইসিইউ, বিশেষত ভেন্টিলেটর সবচেয়ে জরুরি। এর মধ্যে বয়স্কদের আইসিইউ সাপোর্ট বেশি প্রয়োজন পড়ে। আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখেরও ওপরে। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট আইসিইউ বেড রয়েছে ১ হাজার ২৮৫টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ২১১টি। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবে দেশে যে আইসিইউ বেড রয়েছে এর সবগুলোতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেওয়া যাবে না। কারণ করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে কোনো আইসিইউতে ঢোকানো হলে আশপাশে থাকা অন্য রোগীরাও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, যে হাসপাতালগুলোতে করোনার চিকিৎসা দেওয়া হবে সেগুলো ডেজিগনেটেড হাসপাতাল হতে হবে। সেখানে অন্য কোনো রোগীর চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। করোনাভাইরাস আক্রান্তদের জন্য আলাদা আইসিইউর ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহারুল হক বলেন, 'আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কমিউনিটিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে যে পরিমাণ আইসিইউ বেড দরকার হবে, সেই তুলনায় আমাদের রয়েছে খুবই স্বল্প। জনসংখ্যা ও পারসেন্টেজ অব সিনিয়র সিটিজেনের তুলনায় তা একেবারেই কম। আইসিইউ বেডের সংখ্যা শিগগিরই আরও বাড়াতে হবে এবং প্রস্তুত রাখতে হবে।' এদিকে, করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে দুটি হাসপাতালের ১৫০টি বেড প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে আইসিইউ নেই। ফলে করোনা আক্রান্ত কোনো মুমূর্ষু রোগীর আইসিইউ সেবা প্রয়োজন হলেও সেটি দেওয়া সম্ভব হবে না। অথচ করোনায় আক্রান্ত রোগীর অবস্থা যে কোনো সময় মুমূর্ষু হতে পারে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জানান, চট্টগ্রামে শুধু চমেক হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে। কিন্তু সেখানে নিয়মিত আড়াই থেকে তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকেন। করোনার রোগীর চিকিৎসা সেখানে হলে সংক্রমণের শঙ্কা রয়েছে। তাই বিকল্প দুটি হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে হাসপাতাল দুটিতে আইসিইউ না থাকার কথা তিনি নিঃসংকোচে স্বীকার করেন। গত ২১ মার্চ প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের জন্য ১০০ আইসিইউ স্থাপন করা হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৪০০ ইউনিট স্থাপন করা হবে। কিন্তু কবে সে বেড স্থাপন করা হবে, পুরোপুরি আইসিইউ তৈরি না হলেও করোনার জন্য সবচেয়ে জরুরি ভেন্টিলেটর ব্যবস্থা কতটা দ্রম্নত করা হবে- তা নিশ্চিত করে বলেননি তিনি। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অন্যরা কেউ-ও এসব ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বর্তমানে বিশ্ব সবচেয়ে বেশি ভেন্টিলেটরের সংকটে ভুগছে। যথেষ্ট সংখ্যক ভেন্টিলেটর সরবরাহ করার জন্য বিশ্বের বহু দেশের সরকার এখন প্রচন্ড চাপের মুখে রয়েছে। এক বিশেষ ক্ষমতাবলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বহুজাতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল মটরসকে (জিএম) করোনা রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটর চিকিৎসা সরঞ্জাম বানাতে বাধ্য করেছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও অটোমোবাইল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মারুতি সুজুকি ইন্ডিয়া লিমিটেড করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় ভেন্টিলেটর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার খবর এখনো পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, রোগীর ফুসফুস যদি কাজ না করে তাহলে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজটা ভেন্টিলেটর করে দেয়। এর মাধ্যমে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে এবং পুরোপুরিভাবে সেরে উঠতে রোগী হাতে কিছুটা সময় পান। নানা ধরনের ভেন্টিলেশন যন্ত্র দিয়ে এই কাজটা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রায় ৮০% করোনাভাইরাস রোগী হাসপাতালের চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে প্রতি ছয়জন রোগীর মধ্যে একজন গুরুতরভাবে অসুস্থ হতে পারেন এবং তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এই ধরনের মারাত্মক কেসে ভাইরাস রোগীর ফুসফুস বিকল করে দেয়।