নিখোঁজ বিদেশফেরতরাই এখন 'গলার কাঁটা'

প্রকাশ | ০১ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

ফয়সাল খান
ইতালি থেকে আসা প্রবাসীদের আশকোনা হাজী ক্যাম্পে নিয়ে গেলে তারা বিক্ষোভ করেন -ফাইল ছবি
গত ১ মার্চ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রায় চার হাজার মানুষকে খুঁজছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তবে এর অর্ধেক মানুষকেও খুঁজে পায়নি তারা। কোয়ারেন্টিনের ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন অনেকেই। একই অবস্থা দেশের অন্যান্য এলাকাতেও। আত্মগোপনে থাকা এসব বিদেশফেরতই এখন বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। চীনে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকে গত ২৯ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশে ফিরেছেন ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৭৫৪ জন। এর মধ্যে ৫৮ হাজার ১০১ জনের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা গেছে। বাকিদের কোনো হদিস নেই। তাদের খোঁজ নিতে গিয়ে বাড়িতেও পাচ্ছে না প্রশাসনের লোকজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি সারাবিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। চীনের উহান প্রদেশে প্রথম এ রোগে আক্রান্ত হলেও পরে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশেও এ রোগের বিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৫ জন ব্যক্তির মৃতু্য এবং আরও ৫১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এসব আক্রান্তের অল্প কয়েকজন বাদে অধিকাংশই বিদেশফেরত অথবা তাদের কন্টাক্টে থাকা লোকজন। এ কারণে সরকার গত ১ মার্চ থেকে বিদেশফেরতদের তালিকা করে তাদের ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিদেশফেরত নাগরিকদের নামের তালিকা সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসন ও সংস্থাকে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী তালিকা ধরে তাদের খোঁজে নামে প্রশাসন। তবে বেশিরভাগ বিদেশফেরত নাগরিকদের খোঁজে পাচ্ছেন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বিদেশফেরতদের খোঁজে বের করে তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। স্থানীয় প্রশাসন সম্মিলিতভাবে বিদেশফেরতদের তালিকা করে তাদের খুঁজে বের করতে মাঠে নামে। এর মধ্যে বিদেশফেরত নাগরিকের পরিবার ও তার কন্টাক্টে থাকা লোকজনের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়। অনেক বাড়িতে বিশেষ চিহ্ন দিয়ে দেওয়া হয়। আবার কোথাও লাল পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এর ফলে বেশিরভাগ বিদেশফেরতরা প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে চলছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে প্রশাসনের কাছে ভুল ঠিকানা দিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন অনেকেই। মৃদু লক্ষণ থাকলেও ভয়ে আইইডিসিআর বা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না তারা। গত ১ মার্চ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ফিরেছেন ২ হাজার ৪৯২ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১ হাজার ২৪০ জন। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এসব ব্যক্তির খোঁজে মাঠে নামলেও অর্ধেকের বেশি মানুষের সন্ধান পায়নি তারা। দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দক্ষিণ সিটি এক হাজার ২৪০ জনের মধ্যে মাত্র ৫৯২ জনের অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছেন। একইভাবে উত্তর সিটির সব বিদেশফেরতদের সবার হদিস মেলাতে পারেনি। অবস্থান শনাক্তকারীরা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকলেও বাকিরা কোথায় অবস্থান করছেন তা জানতে পারেননি কর্মকর্তারা। এতে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সিলেট বিভাগে ফিরেছেন ২৬ হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে মাত্র ৩ হাজার ৬২ জনকে খুঁজে পেয়েছে প্রশাসন। তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। রাজশাহীতে বিদেশ থেকে ফিরেছেন ১ হাজার ৬৪৪ জন। এর মধ্যে প্রশাসন শনাক্ত করে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছে ৯৯৭ জন। আর বাকিদের হদিস পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিদিনই তাদের খোঁজে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালাচ্ছেন প্রশাসনের লোকজন। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় প্রায় ৪০০ জন বিদেশফেরত নাগরিকের তালিকা পেয়েছে প্রশাসন। এর মধ্যে ৩৩৫ জনকে খুঁজে পেয়েছে তারা। বাকিদের কোনো হদিস নেই। বরিশাল জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান যায়যায়দিনকে জানান, এ জেলায় বিদেশফেরত লোকের সংখ্যা ৪ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৬৯ জনের বাড়ির ঠিকানা অনুযায়ী তাদের চিহ্নিত করা গেছে। বাকিদের ঠিকানা অনুযায়ী খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন বলেন, বিদেশফেরতদের শনাক্ত করার জন্য কাজ করছি। যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তাদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে সবার অবস্থান এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশফেরত বাংলাদেশিদের খুঁজে বের করতে হবে। বের করে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। কেননা সরকারের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আইন প্রয়োগ করা হলেও হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীরা নিয়ম মানছেন না। কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা না গেলে কমিউনিটিতে ভাইরাসটি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে করোনা নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) প্রধান চিকিৎসক ডা. আজহারুল ইসলাম খান বলেন, বিদেশফেরতদের আগেই কোয়ারেন্টিনে নেওয়া উচিত ছিল। তখন বিষয়টা সবার কাছে এত পরিষ্কার ছিল না। কিংবা সরকার বোঝাতে পারেনি। এখনও সময় আছে সবাইকে খুঁজে কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। তাহলে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।