'সামাজিক দূরত্ব' নিশ্চিত না হলে ঝুঁকিতে পড়বে ১৭ লাখ মানুষ

প্রকাশ | ০৪ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

জাহিদ হাসান
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে কঠোর হতে হবে। আর তা না হলে ভাইরাস সংক্রমণের হার শতকরা ১ জন হিসেবে হলেও দেশের প্রায় ১৭ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে পড়বে। যাদের মধ্যে প্রায় ২০ ভাগের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হবে। এমন পরিস্থিতিতে সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসমাগম কমানোর মতো স্বাস্থ্যবিধি পালনে সতর্ক হওয়া জরুরি বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সরেজমিন জানা গেছে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকার দেশব্যাপী ১০ দিনের ছুটি ঘোষণার পর সাধারণ মানুষ ঘরবন্দি অবস্থায় আছেন। তবে দেশের প্রধান সড়কগুলোতে মানুষের জটলা কমলেও গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন অলিগলি ও ছোটখাটো দোকানপাটে জনসমাগম রয়েছে। এতে করে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। মূলত অসচেতনতার কারণেই এমনটি হচ্ছে। এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বুধবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিরোধে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যাওয়ার অনুরোধ জানান। ঘরে অবস্থান করে নিজে সংক্রমণমুক্ত থাকা ও \হদেশকে নিরাপদ রাখার আহ্বান জানান। মন্ত্রী বলেন, দেশজুড়ে লকডাউন চলা সত্ত্বেও অনেকে নির্দেশনা মানছেন না। অনেকে রাস্তায় বের হচ্ছেন। বাজারে ঘোরাফেরা করছেন, চায়ের স্টলে আড্ডা দিচ্ছেন। বিশেষ করে যারা শহর থেকে বাড়ি গেছেন তারা বেশি নিয়মভঙ্গ করছেন। সামাজিক দূরত্ব মেনে না চললে সংক্রমণ ঝুঁকি বৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পর্কে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, গত সোমবার যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের এক গবেষণা বলছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধে সাধারণ জনগণ দৈনন্দিন জীবন যাপনে একে অপর থেকে ব্যক্তিগত (শারীরিক) দূরত্ব তথা সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে না মানলে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪ কোটির মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। এ ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার পর কর্মহীন মানুষ সামাজিক দূরত্ব না মেনে বিভিন্ন গণপরিবহণে চেপে শহর ছেড়েছেন। তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ জনবহুল নগরী থেকে অজান্তেই করোনাভাইরাসের মতো মারাত্মক রোগের জীবাণু শরীরে বহন করে নিয়ে গেছেন কিনা, সেটি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে গ্রামে ফিরে অধিকাংশ মানুষ পিপিই বা সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার না করা ও সামাজিক দূরত্ব মানছেন না। এছাড়া প্রবাস থেকে প্রায় ৬ লাখ মানুষ দেশে ফিরলেও এদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য সংখ্যকের অবস্থান জানা যাচ্ছে না। এতে করে সামাজিকভাবে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, করোনাভাইরাস সম্পর্কে মানুষ কমবেশি অবগত হয়েছে। তবে প্রান্তিকপর্যায়ে অনেকে রোগটির সংক্রমণ প্রতিরোধে একে অপর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের মতো স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। ফলে একজনের হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অন্যজনের শরীরে সংক্রামণ ঝুঁকি বাড়ছে। এ হিসাবে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা ১ জন করে সংক্রামিত হলেও প্রায় ১৭ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে পড়বে। যাদের মধ্যে ২০ শতাংশের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হবে। এমনকি শুধু কোভিড-১৯ চিকিৎসায় প্রায় ১৭ হাজার আইসিইউ শয্যার দরকার হবে। এমন পরিস্থিতিতে সন্দেহভাজন রোগী শনাক্তে জেলা-উপজেলাপর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপে গ্রহণের মাধ্যমে তা দ্রম্নত বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়ছে। ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এর একজন চিকিৎসক নেতা যায়যায়দিনকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশ করোনাভাইরাস প্রতিরোধের প্রথম সুযোগ হাতছাড়া করেছে। ফলে বাংলাদেশের মতো তথাকথিত লকডাউন পদক্ষেপ নেওয়া দেশগুলোকে দ্বিতীয় সুযোগ কাজে লাগানোরা পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। আবার দেশে ভাইরাসটি বিস্তারের কোন পর্যায়ে রয়েছে সেটি বলা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিন শনাক্তকৃত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। যদিও সরকারসংশ্লিষ্টরা ভাইরাসটি পরবর্তী স্তরে না যায় সে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, ছোঁয়াচে রোগ হিসেবে স্বীকৃত করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন-যাপন সর্বোত্তম উপায়। দৈনন্দিন জীবন প্রণালীতে স্বাস্থ্যকর কর্মকান্ড মেনে না চললে এটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ জন্য সমাজের প্রতিস্তরে জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের একজন অধ্যাপক যায়যায়দিনকে বলেন, ভাইরাসটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন তথা সমাজে ছড়িয়ে পড়ার বড় কারণ হচ্ছে যারা বিদেশ থেকে দেশে এসেছেন তাদের অনেকে নির্ধারিত ঠিকানা অবস্থান না করা। উদাহরণস্বরূপ রাজশাহী মহানগরীর ১২টি থানার মধ্যে শুধু বোয়ালিয়া থানায় ৭২৭ জন বিদেশফেরত প্রবাসীর সঠিক অবস্থান জানা যায়নি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অথচ সরকারের নথি অনুসারে তারা দেশে ফিরেছেন। তাদের কারও শরীরে করোনার উপসর্গ থাকলেও জানা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে অন্যের মধ্যে সহজে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে। ডক্টর ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামক সংগঠনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যায়যায়দিনকে বলেন, স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক জাতিসংঘের বিভিন্ন সংগঠন, দাতা সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া একটি নথিতে জানিয়েছে চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার কোনো ধরনের উদ্যোগ না নিলে জনঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে প্রায় ৫ থেকে ২০ লাখের মতো মানুষ মৃতু্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এ জন্য রোগ শনাক্তে অতি দ্রম্নততার সঙ্গে বিভাগীয়পর্যায় ও মেডিকেল কলেজ ইনস্টিটিউটে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষায় তাদের সংগঠন জোর দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত ও আক্রান্তদের চিকিৎসায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।