করোনা ঝুঁকির মধ্যেই ঢাকামুখী মানুষের ঢল

প্রকাশ | ০৫ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২০, ১০:২৯

যাযাদি ডেস্ক
সরকারি ছুটি বাড়লেও গার্মেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কারখানার শ্রমিকের ছুটি বাড়েনি। তাই করোনা আতঙ্ক নিয়েই রোববার কর্মস্থলে যোগ দিতে হাজার হাজার মানুষ ছুটেন রাজধানী অভিমুখে। ছবিটি শনিবার মাওয়া ঘাট থেকে তোলা -যাযাদি

করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি চলছে। সরকারি অফিস-আদালত, গণপরিবহণ বন্ধ। কাঁচাবাজার ও নিত্যপণ্যের দোকান ছাড়া বন্ধ আছে সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আজ থেকে গার্মেন্ট ও বেসরকারি অফিস খোলা থাকায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেই জীবিকার তাগিদে সবকিছু উপেক্ষা করে শনিবার দলে দলে কর্মস্থল অভিমুখে ছুটতে শুরু করেন কর্মজীবী মানুষ। শনিবার দেশের বিভিন্ন ফেরিঘাট, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দেখা গেছে বেসরকারি চাকরিজীবী ও পোশাক শ্রমিকরা পরিবহণ না পেয়ে হেঁটে, মালবাহী লরি ও পিকআপভ্যান চেপে ঢাকায় ফিরছেন। আমাদের গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি জানান, সরকারি ছুটির পাশাপাশি বন্ধ রয়েছে সব ধরনের গণপরিবহণ চলাচল। কিন্তু উল্টো চিত্র দেশের গুরুত্বপূর্ণ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে। এখানে শনিবার দুপুরের পর থেকে কর্মমুখী মানুষের ঢল নামে। ঘাট সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি ছুটি বাড়লেও গার্মেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কারখানার শ্রমিকের জন্য ছুটি বাড়েনি। এ জন্য ৫ তারিখ রোববার কর্মস্থলে যোগ দিতে দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ করোনা আতঙ্ক নিয়েই কর্মস্থলে ছুটছেন। গোয়ালন্দ পৌর এলাকার বাসিন্দা রাবেয়া খাতুন, ফরিদপুরের মধুখালী থেকে আসা গার্মেন্টকর্মী রিনা খাতুন, স্মৃতি আক্তার, সুইটি আক্তার, বুলবুল হোসেন, মোস্তফাসহ অনেকেই জানান, তারা বড়ই অভাগা। তাইতো সরকার ছুটি বাড়ালেও তাদের বাড়েনি। গার্মেন্ট থেকে জানিয়ে দিয়েছে ৫ তারিখ কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না। তাইতো জীবনের মায়া ত্যাগ করে মহাসড়কে নানা ধকল সহ্য করে খোলা পিকআপ, পণ্যবাহী ট্রাক, অটোরিকশাযোগে দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত এসেছেন। ওপার (পাটুরিয়া ঘাট) থেকে কীভাবে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাবেন তা জানা নেই। বিআইডবিস্নউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক আবু আব্দুলস্নাহ রণি জানান, সরকারি আদেশে শুধুমাত্র পণ্যদ্রব্য পারাপারের জন্য এ নৌরুটের ১৬টি ফেরির মধ্যে ১১টি বসিয়ে রেখে মাত্র ৫টি ফেরি চালু রাখা হয়েছে। কিন্তু শনিবার দুপুর থেকে মানুষের চাপে তারা ঠিকমতো পণ্যবাহী যানবাহন পারাপার করতে পারছেন না। প্রতিটি ফেরিতেই মানুষের উপচেপড়া ভিড়। এরা সবাই বিভিন্ন গার্মেন্ট ও অন্যান্য ছোট-খাটো কারখানা ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মী। করোনা ঝুঁকি থাকলেও ফেরিতে এদের এভাবে পারাপার ঠেকানো আসলে সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। শিবালয় (মানিকগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, শনিবার আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাটে দেখা মিলে রাজধানী ঢাকামুখী কর্মজীবী মানুষের ঢল। করোনা মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ থাকায় এরা খোলা পিকআপ, পণ্যবাহী ট্রাক ও রিকশা-ভ্যানে চেপে গাদাগাদি করে ঢাকায় ফিরছেন। পরিবহণ স্বল্পতায় অনেকেই দল বেঁধে পায়ে হেঁটে রওনা দিচ্ছেন ঢাকার পথে। পাটুরিয়া ও আরিচা ঘাটে দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা জানান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে প্রচার-প্রচারণাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না এদের। কোনো বাধাই মানছেন না কর্মমুখী মানুষ। এদিকে, সারাদেশের মতো ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে আঞ্চলিক গণপরিবহণ বন্ধ রয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। এরই মধ্যে খোলা ট্রাক-পিকআপ, সিএনজি, অটোরিকশাযোগে কর্মমুখী মানুষ ছুটছে ঢাকার দিকে। যাত্রা রোধে কিছু-কিছু পয়েন্টে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজাও দেওয়া হয়েছে অনেক পরিবহণ মালিক-শ্রমিককে। শ্রীপুর (গাজীপুর) সংবাদদাতা জানান, পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ায় ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর অঞ্চলের পোশাক কারখানার কর্মমুখী মানুষ পিকআপ, ট্রাক, ভ্যান গাড়িতে করে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছুটছেন। গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় মহাসড়কে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে ছুটছেন তারা। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের চেয়ে তাদের কাছে চাকরি রক্ষা করাটা বেশি প্রয়োজন বলে দাবি করছেন তারা। শনিবার দুপুর ১২টার দিকে দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে ঢাকামুখী যাত্রীরা কেউ হেঁটে যাচ্ছেন, আবার যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভালো তারা ভ্যান বা পিকআপে করে ছুটে চলছেন ঢাকার দিকে। ময়মনসিংহ থেকে গাজীপুরের ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা আর সেখানে এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজে যাওয়ার জন্য ভাড়া গুনতে হচ্ছে দেড়শো থেকে দুশো টাকা। আর অতিরিক্ত টাকা দিয়েই যাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার শ্রমিক সুফিয়া খাতুন জানান, 'কারখানা খুলে গেছে তাই যাচ্ছি। সময়মতো কারখানায় উপস্থিত না হতে পারলে যে কয়দিন ছুটি পাইছি সে কয়দিন অনুপস্থিত দেখাবে কর্তৃপক্ষ। যার কারণে অতিরিক্ত টাকা দিয়েই কারখানায় যাচ্ছি।' গাজীপুর সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর এলাকার এন এ জেড বাংলাদেশ লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাদের তৈরি পোশাক কারখানা ৫ এপ্রিল থেকে খোলা হচ্ছে। সরকারি নির্দেশেই তারা কারখানা খোলা রেখেছেন। কর্মস্থলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হবে। মাওনা হাইওয়ে থানার ওসি মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ট্রাক পিকআপ চালকদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। যাত্রীদেরও ওইসব পরিবহণ থেকে নেমে যেতে বলা হচ্ছে। অনেকে দলবেঁধে পায়ে হেঁটে গাজীপুর মহানগর ও ঢাকা অভিমুখে চলছেন। অপরদিকে পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, কারখানা বন্ধের সময় শ্রমিকদের নিজ নিজ বাসায় অবস্থানের কথা বলা হলেও তারা কেন গ্রামে গেছে। এখন বেতন নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের ঢাকা ফেরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান বলেন, 'আমরা কারখানা বন্ধের সময় সব শ্রমিককে নিজ বাসায় নিরাপদে অবস্থান করতে বলেছিলাম। তাদের বলা হয়েছিল বেতন নির্দিষ্ট সময়ে তারা পেয়ে যাবেন। বর্তমানে গণপরিবহণ বন্ধ। তাদের বলা হলো বাসায় অবস্থান করতে কিন্তু তারা চলে গেলেন গ্রামের বাড়িতে। শ্রমিকরা যে গ্রামে গেছে এটা জানা ছিল না।' তিনি বলেন, এখন তারা আবার ঢাকায় আসছেন বেতনের জন্য। যারা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতন পান এক্ষেত্রে তাদের বেতন নিতে আসার প্রয়োজন নেই। যথাসময়ে তাদের বেতন অ্যাকাউন্টে চলে যাবে।' এদিকে, গাদাগাদি করে গ্রাম থেকে ঢাকামুখী এসব মানুষের ফেরা কতটা নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে গাদাগাদি করে ঢাকায় ফেরা সাংঘাতিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে সবাইকে। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মুজিবুর রহমান বলেন, 'ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে কিংবা এক সঙ্গে গাদাগাদি করে আসা সাংঘাতিক বিপদ ডেকে আনতে পারে। আগতদের মধ্যে একজনের করোনা পজিটিভ থাকলে তার মাধ্যমে কারখানায় ছড়াবে, বাসায় ছড়াবে। তিনি যেখানে অবস্থান করবে হয়তো সেখানেই সমস্যা তৈরি হবে।'