জীবাণুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজারই এখন জীবনের জন্য ঝুঁকি!

প্রকাশ | ০৫ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
রাজধানীতে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহার বেড়েছে -ফাইল ছবি
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সাধারণ মানুষের মধ্যে হ্যান্ড রাব-এর (স্যানিটাইজার) ব্যবহার বেড়েছে। তবে অতিরিক্ত চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় একটি অসাধু চক্র নকল হ্যান্ড রাব তৈরি করে তা বাজারজাত করছে। আবার কেউ কেউ ঘরেই বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, এমনকি দুস্থ মানুষের মধ্যে বিলাচ্ছেন। এ ধরনের কার্যক্রমে বেশ কিছু রাজনৈতিক সংগঠনও যোগ দিয়েছে। অথচ এসব হ্যান্ড স্যানিটাইজারে জীবাণু ধ্বংস করার মতো উপযুক্ত উপাদান না থাকায় জীবণুনাশক এ পণ্যটিই এখন জীবনের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিজ্ঞ ফার্মাসিস্টরা জানান, স্যানিটাইজার তৈরির প্রধান কাঁচামাল হিসেবে আইপিএ (আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল) ব্যবহার করা হয়। যা মূলত জীবাণু ধ্বংসের প্রধান উপাদান। অথচ নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজারে তা ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে এই নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা রাব জীবাণু ধ্বংসে কোনো কাজে লাগে না। অথচ না জেনে সাধারণ মানুষ এসব নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাতে মেখে নিজেকে জীবাণুমুক্ত ভাবছে। ওই হাতে তারা নিঃসংকোচে খাওয়া-দাওয়া সারছে, নাকে-মুখে হাত দিচ্ছে। এতে তার হাতে থাকা জীবাণু শরীরে প্রবেশ করছে। যা করোনা প্রকোপের এই দুঃসময়ে জীবনের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্যদিকে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদান কমবেশি মিশ্রণের ফলে তা ত্বকের ক্ষতি করছে বলে দাবি করে রসায়নবিদরা বলেন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল, অ্যালোভেরা অয়েল, গিস্নসারিনসহ নানা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। মানব ত্বকের সহনশীল মাত্রা অনুযায়ী এগুলো মেশানো জরুরি। এসব উপকরণ কমবেশি হলে ত্বকের ক্ষতি হয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকায় এই ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য শরীরে ব্যবহারের ফলে চর্মরোগের বিস্তারসহ নানা জটিল সমস্যাও দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গে বলেন, ত্বকে ব্যবহার অনুপযোগী বেশকিছু রাসায়নিকদ্রব্য নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এগুলো ব্যবহার করলে ইনফেকশনসহ নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। তখন জীবাণুমুক্ত হতে গিয়ে উল্টো শরীরে রোগবালাই ছড়াবে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত দুই ধরনের হ্যান্ড স্যানিটাইজার জীবাণুমুক্তকরণ কাজে ব্যবহৃত হয়। এর একটি হচ্ছে- অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং অপরটি অ্যালকোহলমুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার। অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজারে বিভিন্ন পরিমাণে বিভিন্ন প্রকৃতির অ্যালকোহল থাকে। সাধারণত ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল, ইথানল (ইথাইল অ্যালকোহল) অথবা এন-প্রোপানল থাকে। অ্যালকোহল অধিকাংশ জীবাণু ধ্বংস করে। অন্যদিকে, অ্যালকোহলমুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজারে অ্যালকোহলের পরিবর্তে কোয়াটারনারি অ্যামোনিয়াম কম্পাউন্ড (সাধারণত বেনজালকোনিয়াম ক্লোরাইড) থাকে। এসব হ্যান্ড স্যানিটাইজার জীবাণু ধ্বংস অথবা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমানোর ক্ষেত্রে অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজারের অপেক্ষা কম কার্যকর হয়ে থাকে। গবেষণা বলছে, অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার শুধু বিভিন্ন প্রকৃতির ব্যাকটেরিয়াই ধ্বংস করে না, বরং এটি বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসও ধ্বংস করতে কার্যকর। অ্যালকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারে ধ্বংস হয় এমনকিছু ভাইরাস হলো- ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ভাইরাস, রাইনোভাইরাস, হেপাটাইটিস এ ভাইরাস, এইচআইভি ও মার্স। তবে হাত পরিষ্কার করতে স্যানিটাইজারের পরিবর্তে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলাই সবচেয়ে ভালো। গবেষণায় দেখা গেছে, সাবানের পরিষ্কারক প্রতিক্রিয়া ও ধোয়ার ঘর্ষণ উভয়ে হাতের জীবাণু, নোংরা ও অর্গানিক ম্যাটেরিয়াল দূর করতে একত্রে কাজ করে। এদিকে, ঘরে তৈরি হ্যান্ড স্যানিটাইজার কতটা নিরাপদ তা নিয়েও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেন, 'দোকানে যদি হ্যান্ড স্যানিটাইজার পাওয়া না যায় তবে ঘরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিকে আমরা কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করছি। ঘরে বসে বিভিন্ন কেমিক্যাল পণ্য নিয়ে খেলা ভেবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করা ও সেটা ব্যবহার করা আশঙ্কাজনক এবং এটা থেকে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা থাকে।' সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, কোন উপাদানগুলো মিশালে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি হয় এটা জানা এবং নিরাপদ ও ব্যবহারযোগ্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। বাণিজ্যিকভাবে যেসব হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করা হয় তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা ও যাচাইবাছাই করেই বাজারে ছাড়া হয়। অথচ ইন্টারনেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির বহু ফর্মুলা পাওয়া যায়। কিন্তু এর কোনটা কার্যকর, সঠিক ও নিরাপদ সেটা কেউই জানে না। এছাড়া কেমিক্যাল উপাদানের পরিমাণে সামান্য এদিক-সেদিক হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ যে কোনো রাসায়নিক ফর্মুলাই বিপজ্জনক হতে পারে। এক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদনপ্রাপ্ত কোম্পানির হ্যান্ড স্যানিটাইজার সহজলভ্য না হলে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়াই শ্রেয় ও নিরাপদ বলে মনে করেন তারা। এদিকে, বাজারে তৈরি সব কোম্পানির হ্যান্ড স্যানিটাইজারই যে নিরাপদ এ নিশ্চয়তাও দিতে চান না অভিজ্ঞ ফার্মাসিস্টরা। তাদের ভাষ্য, স্যানিটাইজারে কী কী উপাদান আছে সেটার উপর নির্ভর করে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নাকি ভালো। স্যানিটাইজার ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে তারা জানান, ট্রাইক্লোসানসম্পন্ন স্যানিটাইজার যে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিহত করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ ধরনের স্যানিটাইজিং জেল ভালো থেকে খারাপ প্রভাবই বেশি ফেলে। ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) তথ্য অনুযায়ী, ট্রাইক্লোসান অ্যান্টিবায়োটিক থেকে ব্যাকটেরিয়াকে রক্ষা করে, যদিও উপাদানটি এর বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। এছাড়া দেহে এমআরএসএ-এর মতো সুপারবাগও সৃষ্টি করতে পারে এই ট্রাইক্লোসান, যা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং স্নায়ুকোষ ধ্বংস করে দেয়। এছাড়া শরীরের প্রয়োজনীয় হরমোন সৃষ্টিতেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এই ট্রাইক্লোসান। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এদিকে, স্যানিটাইজারে ভিন্ন ভিন্ন প্যারাবিন ব্যবহৃত হয়। উলেস্নখযোগ্য কয়েকটি প্যারাবিন হলো- ইথাইলপ্যারাবিন, বিউটাইলপ্যারাবিন, মিথাইলপ্যারাবিন এবং প্রোপাইলপ্যারাবিন। প্যারাবিন ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করলেও এর এই একটি গুণের বিপরীতে রয়েছে শত শত দোষ। বিভিন্ন ধরনের বিপজ্জনক শারীরিক সমস্যা, যেমন- ক্যান্সার, নিউরোটক্সিসিটি, এন্ডোক্রাইন ডিসরাপসন এবং ত্বকের চুলকানি দেখা যায়। বাজারে যেসব স্যানিটাইজার আছে এর মধ্যে অ্যালকোহলপূর্ণ স্যানিটাইজারই সবচাইতে ভালো। তবে এগুলোও পুরোপুরি নিরাপদ নয়। এক গবেষণায় দেখা যায়, যারা অ্যালকোহল স্যানিটাইজিং জেল ব্যবহার করে তাদের রক্তেও অ্যালকোহল পাওয়া যায়। কিছু কিছু স্যানিটাইজারে আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহলও থাকে। এটি এক ধরনের পেট্রোকেমিক্যাল, যা নিউরোটক্সিন নামেও পরিচিত। এই অ্যালকোহল ত্বক শুষে নেয় এবং দেহে বিষের মতো কাজ করে। এসব স্যানিটাইজার ত্বকের সুরক্ষা স্তরগুলোকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে ফেলে। এর মানে এই না যে, অ্যালকোহলবিহীন স্যানিটাইজিং জেল ভালো। এগুলো বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান, যেমন- বেনজালকোনিয়াম ক্লোরাইড দিয়ে তৈরি হয়। এই উপাদান ইমিউন ডিসফাংশন এবং হাইপারসেনসিটিভিটির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট এবং ক্রোনিক ডার্মাটাইটিসের মতো রোগের সৃষ্টি করে। এদিকে, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল স্যানিটাইজার ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিহত করে তা ঠিক। কিন্তু খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে ভালো ব্যাকটেরিয়াও মেরে ফেলে। ফলে এই ধরনের স্যানিটাইজিং জেল, যা শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল জেল অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তোলে।