চিকিৎসকের চেম্বারও বন্ধ

করোনা নয়, বিনা চিকিৎসায় অন্য রোগীর মৃতু্য বাড়ার শঙ্কা

ভীতসন্ত্রস্ত চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ চিকিৎসাসেবা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। তাদের ব্যক্তিগত চেম্বার সপ্তাহ দেড়েক আগেই বন্ধ করে দিয়েছেন

প্রকাশ | ০৬ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
সারাদেশে এখন পর্যন্ত করোনায় আটজনের মৃতু্য এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭০ জন হলেও ভীতসন্ত্রস্ত চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ বেশ আগেই সাধারণ চিকিৎসা সেবা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। বেশির ভাগ চিকিৎসক তাদের ব্যক্তিগত চেম্বার সপ্তাহ দেড়েক আগেই বন্ধ করে দিয়েছেন। সরকারি হাসপাতালের কর্মস্থলে চিকিৎসকদের উপস্থিতিও বেশ সীমিত। তারা নিজেদের মধ্যে শর্টটাইম শিডিউল করে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে কিডনি-হৃদরোগসহ অন্যান্য অসুখে গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় করোনার চেয়ে সাধারণ রোগে আক্রান্ত অনেক বেশি মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে পারে বলে স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। এদিকে সারাদেশে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থার এ নাজুক চিত্রে খোদ সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে গোটা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখার তাগিদ দিয়েছেন। এর আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রীও চিকিৎসকদের একাধিকবার এ আহ্বান জানান। তবে তার এ অনুরোধে কোনো কাজ না হওয়ায় এবার তিনি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রীতিমতো ব্যবস্থা নেওয়ার কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও প্রাইভেট চেম্বারগুলোতে রোগীরা সেবা না পেয়ে ফিরে গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পার্সোনাল প্রটেকশন ইকু্যইপমেন্ট (পিপিই) না থাকার অজুহাতে চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ সাধারণ চিকিৎসা সেবা প্রদানের দায়িত্ব থেকে সরে গেলেও এখন এ সরঞ্জামাদির সরবরাহ বাড়ার পর তারা নানা তালবাহানা শুরু করেছে। এমনকি অনেকে নিজের অসুস্থতার কথা বলে হাসপাতালের রুটিন দায়িত্ব পালনেও ফাঁকি দিচ্ছেন। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী এবং এতে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়লে সারাদেশে সাধারণ চিকিৎসা সেবা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে বলে আশঙ্কা করেন তারা। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকের দাবি, করোনা আতঙ্কে ছোটোখাটো রোগ নিয়ে মানুষ সাধারণত হাসপাতালে আসছে না। এমনকি মরণঘাতি এ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কায় জটিল রোগ নিয়েও অনেকে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার কিংবা হাসপাতালে আসতে ভয় পাচ্ছেন। ফলে কোনোখানেই রোগীর তেমন চাপ নেই। এ কারণে অনেক চিকিৎসক ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রয়েছে। যদিও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর ফিরে যাওয়ার অভিযোগসহ চিকিৎসা সেবার নানা নাজুক অবস্থার কথা খোদ স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টরা নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল হাসান বলেন, হাসপাতালে গিয়ে রোগীরা যে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, এই খবর তারা পাচ্ছেন। কীভাবে রোগীদের কষ্ট কমানো যায়, শিগগিরই তার উপায় খুঁজে বের করা হবে। তবে কবে নাগাদ চিকিৎসকরা তাদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা শুরু করবেন এবং হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা স্বাভাবিক হবে তার কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। এদিকে ঢাকার বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও প্রাইভেট চেম্বারে আগের মতো স্বাভাবিকভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার বিষয় তুলে ধরেন। তারা জানান, তাদের ব্যক্তিগত চেম্বারে শুধু আশপাশের এলাকা থেকেই রোগী আসে না। বিভিন্ন রেফারেলে দূর-দূরান্ত থেকেও বিপুল সংখ্যক রোগী চেম্বারে আসত। অথচ বাস-ট্রেনসহ সব গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় তারা এখন আসতে পারছে না। এছাড়া সিএনজি অটোরিকশাতে আসার পথেও পুলিশ অনেককে বাধা দিচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীর সংখ্যা একেবারেই কম। এ অবস্থায় এক দু'জন রোগীর জন্য দীর্ঘ সময় চেম্বার খুলে রাখা কোনো চিকিৎসকের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিতদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ও বিমা ব্যবস্থা থাকলেও চিকিৎসকদের এ সুযোগ নেই। এ কারণে এ দুঃসময়ে চিকিৎসকরা ঝুঁকি নিতে ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়াতে চাচ্ছে না। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সন্দেহভাজন করোনা রোগীকে পরীক্ষা করে তিনি এ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত কি না তা শনাক্ত করার সুযোগ না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানে আগের মতো চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখার ঝুঁকি নিচ্ছে না। কেননা, সন্দেহভাজন রোগীকে ভর্তির পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় অথবা তার মৃতু্যর পর আইইডিসিআরের পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়লে গোটা হাসপাতাল লকডাউন করে দেওয়া হচ্ছে। যে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অসম্ভব। সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে গুটি কয়েক উদাহরণ টেনে জানান, গত ২১ মার্চ করোনার উপসর্গ নিয়ে একজন ব্যক্তি রাজধানীর ডেল্টা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানটি লকডাউন করে দেওয়া হয়। প্রায় একই সময় কিশোরগঞ্জের ভৈরবের দুই হাসপাতালে ইতালিফেরত এক ব্যক্তি চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃতু্য হওয়ায় ওই দুটি হাসপাতালও লকডাউন করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। ফলে ওই সব প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ পরিস্থিতিতে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সাধারণ চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখতে হলে সেখানেও করোনা পরীক্ষার সুবিধা রাখা জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে এ সুযোগ সৃষ্টি করা না হলে শুধু হুমকি-ধমকি দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণ সেবা কার্যক্রম আগের মতো চালু রাখা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা জানান, গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর এনএস১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা সরকারি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এতে রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি দেখা দেয়। তবে পরবর্তীতে দেশের বেসরকারি সব হাসপাতাল-ক্লিনিকে নির্ধারিত ফি দিয়ে এনএস১ পরীক্ষার সুযোগ করে দেওয়ায় সংকটময় পরিস্থিতি দ্রম্নত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। এ সময় দেশে মোট ডেঙ্গু রোগীর ৮০ শতাংশই বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে হয়েছে। এ অবস্থায় দেশের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করার সুযোগ দেওয়া হলে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা দ্রম্নত স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কেননা তখন করোনার উপসর্গ নিয়ে কেউ বেসরকারি হাপসাতাল-ক্লিনিকে আসলেই প্রথমেই তাকে পরীক্ষা করে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তাকে প্রয়োজনে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া যাবে। এতে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের অন্য রোগী কিংবা চিকিৎসক-নার্সদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কোনো ঝুঁকি থাকবে না। তবে এসব বিষয় চিকিৎসকদের স্রেফ তালবাহানা এমন দাবি করে ভুক্তভোগীদের অনেকের অভিযোগ, বিশ্বের অন্যান্য দেশে নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও চিকিৎসকরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের মহান দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এ দৃষ্টান্ত রয়েছে। অথচ দেশে করোনা আতঙ্কে নানা অযুহাত দেখিয়ে চিকিৎসকরা যেভাবে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে তা সারাবিশ্বে নজিরবিহীন। এদিকে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা আতঙ্কে চিকিৎসকরা নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ রোগী ও তাদের স্বজনদের উদ্বেগের পারদ শীর্ষ মাত্রায় পৌঁছেছে। যে কোনো সময় তাদের অবস্থার অবনতি হলে তারা কোথায় কার কাছে ছুটবেন, সে দুশ্চিন্তায় অনেকেরই রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। গুলশানের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছেন। এতদিন ধরে তিনি বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এ বি সিদ্দিকীর নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে আসছেন। তবে সম্প্রতি তিনি তার ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন। এ অবস্থায় তাকে বিকাশের মাধ্যমে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে পরে হোয়াটসআপে কল করে চিকিৎসা নিয়েছে। তবে গুরুতর অবস্থায় এভাবে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব নয়। যে কোনো সময় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তখন কী উপায় হবে- এ নিয়ে তিনি ও তার পরিবার চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজারবাগ কদমতলার বাসিন্দা জাহানারা বেগম জানান, টনসিলের ইনফেকশনের কারণে তার কিশোরী মেয়ের বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই প্রচন্ড গলা ব্যথা। মার্চের মাঝামাঝিতে তিনি স্থানীয় একজন চিকিৎসককে দেখানোর পর তিনি দুই সপ্তাহের ওষুধ দিয়েছিলেন। ওই ওষুধ তিন দিন আগে শেষ হওয়ার পর ওই চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে জানতে পারেন, সপ্তাহখানেক আগে থেকেই তিনি রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। পরে তিনি একাধিক হাসপাতাল-ক্লিনিকে গেলেও গলাব্যথার কথা শুনে কেউ তার মেয়েকে চিকিৎসা করতে চাননি। এ নিয়ে তিনি ও গোটা পরিবার চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশেই এ ধরনের সাধারণ রোগে আক্রান্ত হয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ ঘরবন্দি রয়েছেন। কেউ কেউ আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত চিকিৎসকদের কাছ থেকে টেলিফোনে পরামর্শ নিয়ে তাদের প্রেসক্রাইব করা ওষুধ খাচ্ছেন। এ দুঃসময়ে অনেকে গুগল ঘেঁটে নিজেই নিজের বা পরিবারের ওষুধ খুঁজে নিচ্ছেন। যা অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এ অবস্থার দ্রম্নত নিরসন সম্ভব না হলে করোনার চেয়ে অন্য রোগে আক্রান্ত কয়েকগুণ বেশি মানুষ মারা যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। এদিকে তাদের এ আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা গত কয়েক দিনে দেশে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া রোগীর পরিসংখ্যান চিত্রে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেখা গেছে, সারাদেশে প্রতিদিনই নূ্যনতম ৪-৫ জন এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ছুটে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। যাদের একটি বড় অংশ করোনায় আক্রান্ত নন। এমনকি এদের অনেকের শরীরে এ রোগের কোনো উপসর্গও ছিল না।