খোলা-বন্ধের খেলায় মারাত্মক ঝুঁকিতে লাখো গার্মেন্টকর্মী

প্রজ্ঞাপনে গার্মেন্ট খোলা রাখার কথা বলা হয় চ্যালেঞ্জ স্বাস্থ্যের, প্রণোদনা ব্যবসায়ীদের ২ লাখ কর্মী ঝুঁকি নিয়ে মাঠে থাকলেও উপেক্ষিত পুলিশ গার্মেন্টকর্মীদের ঠেকাতে রাতের বেলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ

প্রকাশ | ০৬ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

নূর মোহাম্মদ
রোববার রাজধানীর বেশ কয়েকটি গার্মেন্ট খোলা ছিল। এসব কারখানার পোশাক শ্রমিকরা সকালে দলে দলে কর্মস্থলে যোগ দেন। ছবিটি হাতিরঝিল এলাকা থেকে তোলা া-যাযাদি
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন অংশে চরম সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে গত দুদিনে ঘটে যাওয়া পোশাক কারখানা খোলা-বন্ধের খেলায় সমন্বয়হীনতা আরও স্পষ্ট হয়েছে।  সরকার এবং বিজিএমইএর এমন দায়িত্বহীনতা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে কয়েক লাখ গার্মেন্টকর্মী। শুধু তারাই নন, পুরো দেশই এখন আরও করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকিতে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রোববার থেকে গার্মেন্ট খোলা হবে- এমন খবর পেয়ে গত দুদিনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হেঁটে ঢাকা ও আশপাশের গার্মেন্টগুলোতে হাজির হয়েছেন শ্রমিকরা। এতে করে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত শনিবার রাতের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত গার্মেন্ট বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক। এদিকে বেতন ও চাকরির অনিশ্চয়তা নিয়ে বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে পড়েছেন খাবারের আরেক অনিশ্চয়তায়। এদিকে শনিবার গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঢাকা অভিমুখে ঢল ঠেকাতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশনা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর গতকাল রোববার আইজিপি ঢাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন।   সংশ্লিষ্টরা জানান, যদিও উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা খোলা রাখার সুযোগ দেওয়া হয় জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপনেই। গত ১ এপ্রিল সরকারি ছুটি বাড়িয়ে দেওয়ার প্রজ্ঞাপনে এ সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া  হয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এ সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকবে। দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সচিবালয়ে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ ঘোষণা দেন। তিনি জানান, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও তার পরের দুদিন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। এর সঙ্গে মার্চের ২৯, ৩০, ৩১ মার্চ এবং ১ ও ২ এপ্রিলের সাধারণ ছুটি সংযুক্ত করা হয়েছে। এরপর ৩ ও ৪ এপ্রিল আবারও সাপ্তাহিক ছুটি। এছাড়া বিভাগীয় ও জেলাশহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জন্য বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে সেনাবাহিনী নিয়োজিত হবে। এ সময় কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান, খাবারের দোকান ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান ছাড়া অন্য সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বন্ধ থাকবে সব ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মসজিদে না গিয়ে বাড়িতে নামাজ পড়ার জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়। গণপরিবহণ বন্ধ না করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় গ্রামমুখী হয় অসচেতন মানুষ। এতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিলে গণপরিবহণ বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয় সরকার। এ ছুটি শেষ হওয়ার আগেই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে গত ১ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রজ্ঞাপনে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে দেয় সরকার। এ প্রজ্ঞাপনে প্রয়োজনে ওষুধ শিল্প, উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা চালু রাখা যাবে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফলে সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেন গার্মেন্ট মালিকরা। তারা ৫ এপ্রিল শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। বেতন ও চাকরির অনিশ্চয়তার ভয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামাজিক দূরত্ব উপেক্ষা করে এমনকি গণপরিবহণ না পেয়ে হেঁটে কর্মস্থলের দিকে রওনা দেন। বিষয়টি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার ও বিজিএমইএ। রাজধানীমুখী মানুষের ঢল ঠেকাতে শনিবার রাতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। চ্যালেঞ্জ স্বাস্থ্যের, প্রণদোনা ব্যবসায়ীদের :  করোনাভাইরাসে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত দেশ আমেরিকা। দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়েছে। মারা গেছে প্রায় ৮ হাজার নাগরিক। দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেক উন্নত। আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশটি এক লাখ ৭০ হাজার ভেন্টিলেটর নিয়ে যুদ্ধ করছে। এরপরও তারা বলছে, মৃতু্যর সংখ্যা ২ লাখে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলেও তারা খুশি। অন্যদিকে বর্তমানে দেশে আমাদের দেশের মোট ভেন্টিলেটরের সংখ্যা মাত্র ৭৫০টি। করোনায় আক্রান্ত রোগীর সেবায় নিয়োজিতরা মানসম্মত পিপিই পাচ্ছেন না। এ দুর্যোগে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে তাদের জন্য নেই কোনো প্রণোদনা। ফলে তারা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা নিজেদের নিরাপত্তার অভাবে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছেন। তার পরও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের উৎসাহিত করতে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২ লাখ কর্মী ঝুঁকি নিয়ে মাঠে থাকলেও উপেক্ষিত পুলিশ : করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে চরম সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে নিজেদের কর্মকর্তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বৈরিতা। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের বঞ্চনার কথা তুলে ধরছেন। বিশ্বের দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য ও সেবা বিভাগ। এতে সশস্ত্রবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২৬ জন সচিব থাকলেও সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) রাখা হয়নি। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দুই লাখ পুলিশ সদস্য কাজ করলেও পুলিশপ্রধানকে কমিটিতে না রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন পুলিশ ক্যাডার কর্মকর্তারা। তারা নিজেদের ফেসবুক পেজে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের এ কমিটিতে পুলিশপ্রধানকে অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এছাড়া সিটি করপোরেশন জেলা/উপজেলায় করোনা প্রতিরোধে গঠিত কমিটিতে পুলিশ প্রশাসনকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এমন অভিযোগ মাঠ প্রশাসনে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের। গত ১ এপ্রিল সরকারি ছুটি বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সে প্রজ্ঞাপনে সচিব, সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ, জেলা প্রশাসক, ইউএনওসহ ১৬ জনকে দেওয়া হলেও মূলত দেওয়া হয়নি সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার পুলিশ মহাপরিদর্শককে। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পুলিশ ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা।