অঘোষিত লকডাউনের সুফল নিয়ে সংশয়!

প্রকাশ | ০৭ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
করোনাভাইরাস রোধে ঢাকা লকডাউন ঘোষণা করায় রাজধানীতে যানবাহন প্রবেশ ও বের হওয়া বন্ধ রয়েছে। সোমবার কয়েকটি গাড়ি যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকা দিয়ে শহরে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ গতিরোধ করে -যাযাদি
প্রতিদিনই পালস্না দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অধিক সংখ্যক করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ায় সারাদেশে স্থানীয়ভাবে লকডাউন করা এলাকার পরিধি দ্রম্নত বাড়ছে। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে গোটা এলাকা লকডাউন করা হয়েছে, তার টেস্ট ও চিকিৎসা কোনোটাই হচ্ছে না। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও পরিবারের লোকজন সামাজিকভাবে নানা নিগৃহের শিকার হচ্ছেন। এ অবস্থায় করোনার উপসর্গ নিয়ে অনেকে জীবন ঝুঁকিতে থাকলেও বিষয়টি গোপন রেখে ঘরে অনুমানভিত্তিক চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এতে অঘোষিত লকডাউনের মূল লক্ষ্য অনেকটাই ভেস্তে যাচ্ছে। অন্যদিকে সারাদেশে যে অঘোষিত লকডাউন রয়েছে তা ভেঙে নিম্নআয়ের মানুষকে নিত্যদিনের দু'মুঠো খাবার জোগাড় করতে রাস্তায় নামতে হচ্ছে। আবার চাকরি হারানোর আশঙ্কায় অনেকে মৃতু্যভয় উপেক্ষা করে কর্মস্থলে যোগ দিচ্ছে। ফলে মরণঘাতি করোনাভাইরাস দ্রম্নত চারদিকে সংক্রমিত হয়ে আনুষ্ঠানিক লকডাউনের পরিধি আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্থানীয় পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ মার্চ দেশে সর্বপ্রথম মাদারীপুরের শিবচর উপজেলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন করা হলেও মাত্র দু'সপ্তাহের ব্যবধানে আরও প্রায় অর্ধশত ছোটখাটো এলাকা, পাড়া-মহলস্নায় এর পরিধি বাড়াতে হয়েছে। এরপরও প্রতিদিন দেশের কোনো কোনো না জেলা থেকে নতুন এলাকা স্থানীয়ভাবে লকডাউন করে দেওয়ার খবর আসছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে একসময় গোটা দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন করে দিতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এদিকে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে লক্ষ্য নিয়ে সরকারি-বেসরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি ছুটি এবং গণপরিবহণ বন্ধ করে সারাদেশে অঘোষিত লকডাউনের আওতায় আনা হয়েছে, এর মধ্যে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হলে তা নিঃসন্দেহে ভেস্তে যাবে। কেননা লাখ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন কারখানায় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত (!) করে নির্ধারিত গন্ডিতে কাজ করলেও দিন শেষে তারা বস্তি কিংবা ঘিঞ্জি এলাকার ঘরে ফিরে যাবে। সেখানে পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেলামেশা করবে। কোনোভাবে এদের কেউ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলে তা হুহু করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, যা সামাল দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে নেই। তাই বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষকে ঘরের বাইরে রেখে অঘোষিত লকডাউনের কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বলে মত দেন তারা। এদিকে সারাদেশে গণপরিবহণ বন্ধ রেখে ৫ এপ্রিল রোববার থেকে পোশাক শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় শুক্র ও শনিবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ শ্রমিককে গাদাগাদি করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরের কর্মস্থলে ছুটতে হয়েছে। যদিও পরে (শনিবার রাতে) বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সব পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে গাদাগাদি করে কয়েক লাখ মানুষ কর্মস্থলে ফেরায় গত কয়েকদিনের অঘোষিত লকডাউনের সুফল কতটা মিলবে তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। অন্যদিকে গত ২৫ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সব অফিস-আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির গতি-পরিধি পর্যালোচনায় তা যথেষ্ট কি না তা নিয়েও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ঘোর সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, নোভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে দেশের নাগরিকদের রক্ষা করতে হলে মাত্র ২০ দিনের অঘোষিত লকডাউন যথেষ্ট নয়। এ স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি পুরোপুরি বোঝা যাবে না। দেশে করোনার সংক্রমণ রোধও অসম্ভব। এ প্রাণঘাতীভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে সারাদেশের মানুষকে নূ্যনতম ৫ থেকে ৭ সপ্তাহ ঘরে থাকার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। তা না হলে করোনা সংক্রমণের গতি আরও বাড়বে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী গবেষকরা বলেন, বাংলাদেশে প্রায় আড়াই সপ্তাহ ধরে চলা লকডাউনের ফলে সংক্রমণ ও নতুন আক্রান্তের সংখ্যা সাময়িক সময়ের জন্য হয়তো কিছুটা কমবে। কিন্তু ফের তা ফিরে আসতে পারে। পরিস্থিতি দেখে তখন হয়তো সরকার কয়েক দিনের ছাড় দিয়ে ফের দীর্ঘমেয়াদি ছুটি ঘোষণা করে সারাদেশ অঘোষিত লকডাউন করবে। তবে এতে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হবে না। বরং মাঝে ছাড় দেওয়ার কারণে ফের করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ছুটি দিয়ে টানা লকডাউনের পক্ষে মত দেন তারা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনা সংক্রমণের প্রাথমিক ধাপ, এর বিস্তৃতি, লকডাউন এবং বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা বলেন, বিশ্বের অধিক সংক্রমিত দেশগুলোর ভয়াবহতার দিকে না তাকালেও প্রতিবেশী ভারতের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশকে এখনই আরও কতটা বেশি সতর্ক হওয়া জরুরি তা অনায়াসেই জানা যাবে। প্রসঙ্গত, ভারতে ৩০ জানুয়ারি প্রথম একজন করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। যা মার্চের মাঝামাঝিতে এসে দাঁড়ায় ১৪৮ জনে। এ সময় করোনায় মৃতের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ জন। তবে পরবর্তী এক সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ এবং মৃতের সংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। ২৪ মার্চ থেকে গোটা ভারত তিন সপ্তাহের জন্য লকডাউন করা হলেও ২৯ মার্চে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা হাজারের কোটা ছাড়ায়। মৃতের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ২৫ জনে। বর্তমানে (৫ এপ্রিল) ভারতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৫৮৮ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১০৪। সেখানকার বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারতের পরিস্থিতি যাতে চিন বা ইতালির মতো না হয় তার জন্য আগামী ৩০ দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থ বা পঞ্চম সপ্তাহেই ভয়াবহভাবে এ ভাইরাস সংক্রমণের নজির রয়েছে। তাই ভারতে যাতে সে পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় এ জন্য তারা লকডাউনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। অন্যদিকে মার্কিন সংস্থা বোস্টন কনসাল্টিং গ্রম্নপের (ইঈএ) রিপোর্টে বলা হয়েছে, জুনের শেষ সপ্তাহ অথবা সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ভারতে লকডাউন চালানো জরুরি। বিসিজির দাবি, ভারতের জনসংখ্যা এবং অনুন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্যই এত তাড়াতাড়ি লকডাউন তুলে নেওয়া সম্ভব হবে না। তা অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়াবে। শুধু তাই নয়, তাদের সমীক্ষা বলছে, জুনের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এসব তথ্যের মাধ্যমে মাত্র ২০ দিনের অঘোষিত লকডাউনে যে বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলা করা যাবে না বিশেষজ্ঞরা সে চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে কয়েকদিনের গ্যাপ না দিয়ে টানা লকডাউনের পরামর্শ দেন তারা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, টানা ৫ সপ্তাহের লকডাউনে যে সুফল পাওয়া যাবে, তা মাঝে গ্যাপ দেওয়া ৮ সপ্তাহের লকডাউনেও না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ৩৫ থেকে ৪৯ দিনের লকডাউনে দেশ হয়তো বেশখানিকটা পিছাবে। তবে এ সময়টুকু লকডাউন মেনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ না রুখলে দেশ অন্তত ৩০ বছর পিছিয়ে যাবে। এদিকে দেশের অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজে দীর্ঘমেয়াদি ছুটি দিয়ে যে কৌশলে অনানুষ্ঠানিক লকডাউন চলছে, তাতে কাজের কাজ খুব বেশি হবে বলে মনে করছেন না স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, এ অঘোষিত লকডাউনের মধ্যে দেশের নিম্নআয়ের মানুষকে যেভাবে নিত্যদিনের খাবার জোগাড়ে রাস্তায় নামতে হচ্ছে, যেভাবে ঠেলাঠেলি ও গাদাগাদি করে ত্রাণ নিতে হচ্ছে তা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুনির্দিষ্ট তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি অতিদরিদ্র কর্মহীন মানুষের ঘরে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিতে না পারলে এ ধরনের কথিত লকডাউন কোনো কাজে লাগবে না বলে মনে করেন তারা। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে যে ফটোসেশনের ত্রাণ কার্যক্রম চলছে তা বন্ধ করা জরুরি বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এ ধরনের ত্রাণ সহায়তায় অতিদরিদ্র মানুষের যতটা না উপকার হচ্ছে, তার চেয়ে বরং বেশি ক্ষতি হচ্ছে। কেননা এসব ত্রাণ দেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় বা স্থান নির্ধারণ না থাকায় দুস্থ মানুষকে এর সন্ধানে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন তাদের সময় অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘরে থাকার যুদ্ধের সময় আরও বাড়ানো জরুরি কি না- এ প্রশ্নের জবাবে রোববার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব যায়যায়দিনকে বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউন নয়, দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি দেওয়া হয়েছে। সাধারণ ছুটিতে সারাদেশে মানুষকে কতটা ঘরে আটকে রাখা গেছে তা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এ অবস্থায় আগামী ১৪ এপ্রিলের পর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ ব্যাপারে কী করণীয় তার দ্রম্নত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। অন্যদিকে লকডাউন না করে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। চিকিৎসক ও গবেষক ড. এম এ হাসান বলেন, সাধারণ ছুটি শব্দগুলোর মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব কমিয়ে ফেলা হয়েছে। এটি সাধারণ ছুটি নয়, সেটি মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য এ বি এম আবদুলস্নাহ সরকারের এ পদক্ষেপকে ত্রম্নটিপূর্ণ বলে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, 'ছুটি শব্দটা বলা সরকারের ভুল হয়েছে। তাছাড়া এটা আরও আগেই নেওয়া দরকার ছিল। দরিদ্র মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকার কিছুটা সময় নিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।