করোনা : এপ্রিল মাসেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি

প্রকাশ | ০৮ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
করোনা সংক্রমণ শুরুর অন্তত এক মাস পর ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে আক্রান্ত এবং মৃতু্যর হার। ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও স্পেনসহ বিশ্বের বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর তথ্য এমনই বার্তা দিচ্ছে। এমনকি যেসব দেশে করোনার প্রকোপ অতিমাত্রায় পৌঁছেনি, সেখানেও এই একই সময় পর এর সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ঠিক চার সপ্তাহের মাথায় এ প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ ঝড়ো গতি পেয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ এখন সংক্রমণ-পরবর্তী পা রাখার পথে থাকায় ৮ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এ দিনগুলোকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ এ সময়টুকু শক্তভাবে সামাল দেওয়া গেলে এ প্রকোপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর এ জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারকে সর্বোচ্চ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জনগণকেও সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে সন্দেহভাজন প্রত্যেক রোগীর করোনা পরীক্ষা করা জরুরি। এছাড়া চিহ্নিত রোগীদের ডেজিগনেটেড হাসপাতালের আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা এবং তাদের স্বজন ও সংস্পর্শে আসা সবাইকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট এলাকা দ্রম্নত লকডাউন করে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। কোনো ধরনের গ্যাপ না দিয়ে সরকারি-বেসরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সব ধরনের শিল্প-কারখানা পুরো এপ্রিল মাস বন্ধ রেখে ঘরে থাকার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষেও মত দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। প্রসঙ্গত, সবচেয়ে খারাপ সময় পার করা যুক্তরাষ্ট্রে গত ১৫ ফেব্রম্নয়ারি করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫। ১৫ মার্চ পর্যন্ত সে সংখ্যা ৩ হাজার ৬১৩। আর ১৭ দিন পর ২ এপ্রিল সংক্রমণ বেড়ে ২ লাখ ১৫ হাজার। একই অবস্থা ইতালিরও। যে দেশে গত ১৫ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত আক্রান্ত ছিল ৩ জন। ১৫ মার্চ ছিল ২৪ হাজার ৭৪৭। সেখানে ২ এপ্রিল সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। ভারতে ৩০ জানুয়ারি প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হলেও ৪ মার্চ থেকে এ সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। এদিন সেখানে ৫ জন রোগী থেকে এক লাফে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ২৮ জনে। পরবর্তী এক মাসে অর্থাৎ ৫ এপ্রিল যা হাইজাম্প দিয়ে সাড়ে তিন হাজারের কোটা পেরিয়ে যায়। মৃতের সংখ্যা এসে ঠেকে ১০৪ জনে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। দেশের সংক্রমণের পর এখনো এক মাস পার হয়নি। যদিও ধীরে ধীরে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা। ৬ মার্চ পর্যন্ত সর্বসাকুল্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১২৩ এবং মৃতের সংখ্যা ১২ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বিশ্বের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে যেমন এক মাস বা তার কিছু সময় পর করোনা সংক্রমণ অনেকগুণ বেড়ে গেছে এবং এটা প্রকট আকার ধারণ করেছে, আমাদের এখানেও সেটা হতে পারে। তাই এপ্রিল পার না হলে আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারব না যে, আমরা কোনদিকে যাচ্ছি। কেননা সারাবিশ্বে ধারণার চেয়ে দ্রম্নতগতিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত করোনায় ২১ হাজার মারা গেলেও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ শেষ না হতেই সে সংখ্যা এখন ৭০ হাজার ছুইছুই। যুক্তরাষ্ট্রে গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত যেখানে করোনায় মৃতু্য ছিল ৬৯ জন। এপ্রিলের শুরুতে লাশের মিছিল ঠেকে ৫ হাজারে। ইতালিতেও গত ১৭ দিনে মারা গেছে প্রায় ১২ হাজার মানুষ। বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি এড়াতে সামাজিক দূরত্বের বিকল্প দেখছেন না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। ঢাকা শিশু হাসপাতালের হাই ডিপেন্ডেন্সি অ্যান্ড আইসোলেশন ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ড. রিয়াজ মোবারক বলেন, ১৫ এপ্রিল বা ২৮ এপ্রিলের পর থেকে আমাদের এ সময়টুকু ভয়ঙ্কর হতে পারে। সব মিলিয়ে এসব তথ্য থেকে বাংলাদেশকে শিক্ষা নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে তা সামাল দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলেন, ক্রুশিয়াল এ সময়টুকু দেশ কীভাবে পার করবে তার ওপর পরবর্তী পরিস্থিতি নির্ভর করবে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহ করোনা রোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য খুব ক্রুশিয়াল সময়। শুধু ক্রুশিয়াল বললে ভুল হবে, বিপজ্জনকও বলা যায়- যোগ করেন এই বিশেষজ্ঞ ভাইরোলোজিস্ট। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যে ছকে এ সময়টুকু ভয়াবহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সে প্রসঙ্গে তারা বলেন, গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম একজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর তার সংস্পর্শে এসে অন্যদের মধ্যেও সেটি ছড়িয়েছে। তারপরও ২০ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল অব্যাহত ছিল। ২০ মার্চ থেকে মাত্র ৪টি রুটে বিমান চলাচল অব্যাহত রেখে বাকি সব রুটের বিমান চলাচল বন্ধ করা হয়। ৮ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত এই ১২ দিনে ৬ লাখেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশে ফিরেছেন। এদের বিমানবন্দরে যে স্ক্রিনিং করা হয়েছে সেই স্ক্রিনিংয়ে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে না। ফলে করোনা আক্রান্ত অনেক রোগী নির্বিঘ্নে দেশে ঢুকে পড়েছে। তাদের সে রোগ প্রকাশ পেতে সর্বনিম্ন ১০ দিন এবং সর্বোচ্চ ২১ দিন লাগছে। আর পরবর্তী সময়ে এদের মাধ্যমে যারা সংক্রমিত হয়েছে তার সংখ্যা জানতেও সমপরিমাণ সময় লাগবে। সে হিসেবে এ মরণব্যাধিতে এখন পর্যন্ত সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা জানতে পুরো এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর এই ২১ দিনই হচ্ছে দ্বিতীয় ধাপের পিক টাইম বা স্প্রেডিং টাইম- যা সবচেয়ে ভয়াবহ। এ সময়টুকুতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে দেশে তা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে না বলে আশা করেন অভিজ্ঞ ভাইরোলোজিস্টরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, এখন যেসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। এই ভাইরাস বাংলাদেশে স্টেজ-থ্রি অর্থাৎ কমিউনিটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখন যদি কমিউনিটি লেভেলে সংক্রমণ শুরু হয় তাহলে দেশে ভয়াবহ ডিজাস্টার ঘটবে। তবে এসব সম্ভাব্য বিপদ অনেক আগেই এড়ানো যেত, যদি বিদেশফেরতদের তাৎক্ষণিকভাবে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে নেওয়া যেত। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের জন্য সবাইকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া সারাদেশ অঘোষিতভাবে লকডাউন করে রাখার লক্ষ্য নিয়ে গত ২৫ মার্চ থেকে সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কলকারখানায় দীর্ঘমেয়াদি ছুটি দেওয়া হলেও কর্মজীবী মানুষকে ঘরে আটকে না রাখার ব্যর্থতা দ্বিতীয় ধাপে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও জেলা-উপজেলা থেকে ৫০ লক্ষাধিক মানুষ গ্রামে ফিরে যাওয়ায় তা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ৫ এপ্রিল থেকে গার্মেন্ট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং গ্রামে ফিরে যাওয়া শ্রমিকদের গাদাগাদি করে কর্মস্থলে ছুটে আসার পর তা আবার বন্ধ ঘোষণা করা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যা সরকারের সমন্বয়হীনতার বহিঃপ্রকাশ বলে অভিজ্ঞজনরা দাবি করেন। এদিকে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখনো সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে তা দেশের জনগণকে ভীষণভাবে ভোগাবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, দেশের স্বাস্থ্যখাতে সমন্বিত কর্মসূচি নেই, আছে আলাদা আলাদা সিদ্ধান্ত। অথচ করোনা মোকাবিলায় এখন সমন্বিত সিদ্ধান্ত সবচেয়ে বেশি জরুরি। এছাড়া জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা ব্যবস্থার অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। পাশাপাশি সেখানে চিকিৎসক ও অন্যান্য দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে। যদিও স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টদের অনেকের দাবি, করোনা মোকাবিলায় এরই মধ্যে বেশকিছু কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিগুলোর ফলে কিছু পরিবর্তন এসেছে। ইনভেস্টিগেশনের ব্যাপকতা বেড়েছে; কিট, পিপিই ইত্যাদির সাপস্নাই চেইন বেড়েছে; লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বেশকিছুটা দেরিতে হলেও বর্তমানে কাজ ভালোভাবেই এগোচ্ছে। যদিও কর্তৃপক্ষের মধ্যে কখনো কখনো সিদ্ধান্তহীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন সরকারি নির্দেশনা জারিতে সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে, নির্দেশনা জারির পর তা বাতিলের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ৩ মাস আগ থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বললেও তা নিয়ে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন। এ প্রসঙ্গে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, প্রথম যখন চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল, তখন মিনিস্ট্রি থেকে সরকারি বেশকিছু হাসপাতালে চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে আইসোলেশন ইউনিট করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী কোনো হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট করা হয়। এছাড়া জানুয়ারিতেই সোসাইটি অব মেডিসিনের পক্ষ থেকে একটি গাইডলাইনও তৈরি করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওই গাইডলাইন উদ্বোধন করেন। তবে এরপর এ সংশ্লিষ্ট সব উদ্যোগ অনেকটা থামকে যায়। ওই সময় থেকে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া হলে বাংলাদেশ কোনো অবস্থাতেই বড় কোনো ঝুঁকির মুখে পড়ত না বলে দাবি করেন ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।