করোনামুক্ত সনদ ছাড়া সাধারণ চিকিৎসা পেতে ভোগান্তি

প্রকাশ | ১৬ মে ২০২০, ০০:০০

জাহিদ হাসান
বিভিন্ন ধরনের রোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে অসুস্থদের সর্দি-কাশি (কমন ফ্লু) বা শ্বাসকষ্ট একটি সাধারণ সমস্যা। তবে করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ এর উপসর্গগুলোও এমন হওয়ায় অন্যান্য রোগের চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন সাধারণ রোগাক্রান্ত রোগীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ক্যানসার, হার্টের রোগ, কিডনি বিকল, উচ্চ-রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বাতরোগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, কলেরা, টাইফয়েড, যক্ষ্ণা ও অ্যাজমাসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভোগা রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু কিছু রোগব্যাধির ক্ষেত্রে সর্দি-কাশি বা শ্বাসকষ্ট একটি সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু চলমান করোনাভাইরাস আতঙ্কে চিকিৎসাকেন্দ্রে ক্রনিক ডিজিজ (দীর্ঘ মেয়াদে ভোগানো রোগ) আক্রান্তদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভর্তি করছেন না। এতে অনেক অসুস্থ মানুষ কোভিড-১৯ পজিটিভ না হয়েও শুধুমাত্র উপসর্গ থাকায় সেবা নিতে পারছেন না। ফলে চিকিৎসাসেবার মতো মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। যদিও রোগীদের বিড়ম্বনা বন্ধে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর প্রতি একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, কাগজে-কলমের ওই নির্দেশনা অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মানছে না। কারণ ইতিপূর্বে করোনার উপসর্গ থাকাসহ সাধারণ রোগীদের সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল তা অমান্য করে রোগীদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতে নজরদারি বাড়াতে প্রয়োজনে টাস্কফোর্স গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে পরিস্থিতির উন্নত হবে না। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য মিডিয়া সেল সূত্র যায়যায়দিনকে বলেন, দেশের সব হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসার পাশাপাশি নন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার ৩টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেখানে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকসমূহে সন্দেহভাজন কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া রেফার্ড করার পূর্বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে যেসব রোগী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন চিকিৎসা গ্রহণ করছেন তারা কোভিড আক্রান্ত না হয়ে থাকলে চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে হবে। নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধান অনুসারে লাইসেন্স বাতিলসহ প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদিকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়া এক রোগীর স্বজন যায়যায়দিনকে অভিযোগ করেন, চলতি মাসের শুরুতে যক্ষ্ণাজনিত কারণে আলতাফ হোসেন (৩৮) নামে তার ছোট ভাইকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। পরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলি ফ্যামিলি মেডিকেলে গেলে সেখানেও ভর্তির আগে করোনামুক্ত সনদ চাওয়া হয়। নিরুপায় হয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নমুনা দান শেষে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে রোগীকে অক্সিজেন দিতে পারলেও করোনামুক্ত সনদ আনার পর মূল চিকিৎসা শুরু হবে বলে জানানো হয়। এদিকে সনদ পাওয়ার আগেই গত ৫ মে মঙ্গলবার তার ভাই মারা যান। একইভাবে ক্রনিক কিডনির সমস্যায় ভোগা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারের শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে একাধিক হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করেও তার স্বজনেরা ব্যর্থ হন। শেষ মুহূর্তে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেও গত ৯ মে শনিবার অনেকটা বিনা চিকিৎসায় তার মৃতু্য হয়। গত রোববার রাতে করোনা উপসর্গ নিয়ে নারায়ণঞ্জের বাসিন্দা রিমন সাউদ (২৫) নামে এক যুবক অসুস্থতাবোধ করলে স্বজনরা তাকে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। তবে করোনার উপসর্গ জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট থাকায় কোনো হাসপাতালই ভর্তি নেয়নি। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃতু্য হয়। এসব বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদরা যায়যায়দিনকে বলেন, সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্য গেলেও কিছু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী করোনায় আক্রান্ত কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য করোনামুক্ত সনদ দেখতে চাইছে। এদিকে করোনা পরীক্ষা সহজে করতে না পারা ও সনদপ্রাপ্তি বিলম্ব হওয়ায় রোগীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। আবার ভর্তি রোগী করোনায় আক্রান্ত জানার পর হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে এমন অভিযোগও আছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার গঠিত ১৭ সদস্যের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সংশ্লিষ্টরা একটি উপ-কমিটি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পৃথক প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দিয়েছে। যেখানে কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক, মানসিক স্বাস্থ্য, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিষয়ে বলা হয়েছে। তবে কমিটির সুপারিশ গুরুত্ব কম পাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কমিটির দুজন সদস্য যায়যায়দিনকে বলেন, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে এখনই দ্রম্নত নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। কোন হাসপাতালে কত শয্যা, কখন কত শয্যা ফাঁকা, কতজন চিকিৎসক, নার্স দায়িত্ব পালন করছেন এসব তথ্য নজরে আনার কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। রোগী কোনো হাসপাতালে গেলে তাকে ফিরিয়ে না দিয়ে দেখতে হবে কোন হাসপাতালে পাঠানো যায়। রোগীকে চিকিৎসা দিতে অপারগ হলেও অন্য হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বিনা চিকিৎসায় ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মোজাহেরুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, জাতীয় কমিটি যে প্রতিবেদন ও সুপারিশ করেছে সবকিছু দেখভালের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। বিষয়গুলোর নজরদারি ও তদারকির জন্য একটি সেলও খোলা হয়েছে। তারা বাস্তবায়ন না করলে চিকিৎসা জটিলতা আরও বাড়বে। তাই ভোগান্তি দূর করতে সমন্বয়হীনতা ও কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণে আরও বেশি জোর দিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা) ডা. আমিনুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশিকায় বিষয়টি ছাড়াও অধিদপ্তর থেকেও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে আসা রোগীর কোনো যদি কোভিড-১৯ আক্রান্ত বলে সন্দেহ হয় এবং যদি কোনো কারণে ওই রোগীকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব না হয়, তাহলে তাকে ওই হাসপাতালেই অপেক্ষমাণ রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ৪টি নম্বরে কল করে ভর্তি ও চিকিৎসাসংক্রান্ত পরামর্শ নিতে বলা হয়েছে। তারপরও এসবের ব্যত্যয় হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।