শীতের পাখি :প্রকৃতির অতিথি

প্রকাশ | ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

কালিমুলস্নাহ ইব্রাহীম
শীতকালে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে একটি বিশেষ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এ সময় হাজারো পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশের জলাভূমি, হাওড়, বিল, বনাঞ্চলে এসে জমায়েত হয়। এসব পাখিকে আমরা 'শীতের পাখি' বলে থাকি। এরা মূলত শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে উষ্ণ আবহাওয়ার সন্ধানে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। তাদের আগমন যেমন প্রকৃতিকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে, তেমনই আমাদের ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শীতের পাখির আগমনের কারণ শীতকালীন সময়ে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোতে তীব্র শীত, তুষারপাত এবং খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এসব অঞ্চলে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যাওয়ার ফলে পাখিদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তারা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে অভিবাসন করে। বাংলাদেশ, যার জলাভূমি এবং উর্বর পরিবেশ শীতের পাখিদের জন্য আদর্শ, এই অতিথিদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। প্রধান শীতের পাখি বাংলাদেশে আগত শীতের পাখির মধ্যে বেশ কয়েকটি উলেস্নখযোগ্য প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি হলো: ১. গাংচিল : জলাভূমি ও নদীর ধারে দেখা যায়। এরা মাছ ও ছোট জলজ প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে। ২. বুনোহাঁস : শীতকালে বিল ও হাওড়ে এদের ঝাঁকবেঁধে উড়তে দেখা যায়। ৩. লাল মাথা চখাচখি : এরা সাধারণত শান্ত পরিবেশ পছন্দ করে এবং জলাশয়ের আশপাশে বাস করে। ৪. চিত্রাহাঁস : সুন্দর পালকের জন্য বিখ্যাত। এরা মূলত হাওড় অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। ৫. ডাহুক : এরা সাধারণত কাদাযুক্ত স্থানে থাকে এবং জলের পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করে। শীতের পাখির আচরণ শীতের পাখিরা সাধারণত খুবই সক্রিয় এবং দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। এরা জলাশয়ে খেলা করে, খাদ্য সংগ্রহ করে এবং নির্ধারিত সময়ে বিশ্রাম নেয়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় তাদের আনাগোনা বেশি লক্ষ্য করা যায়। পাখিদের মধ্যে এক প্রকার শৃঙ্খলাবোধ কাজ করে- যা তাদের দলগত কার্যক্রমে সহায়ক। শীতের পাখি এবং বাংলাদেশের পরিবেশ শীতের পাখিরা শুধু আমাদের দেশের সৌন্দর্য বাড়ায় না, বরং পরিবেশগত দিক থেকেও বেশ উপকারী। তারা জলাভূমির পোকামাকড় ও জলজ উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল- যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। পাখিদের আগমনে জীববৈচিত্র্য আরও সমৃদ্ধ হয়। তবে বর্তমানে জলাভূমি হ্রাস, দূষণ এবং নির্বিচারে পাখি শিকার শীতের পাখিদের জন্য হুমকিস্বরূপ। এসব কারণ তাদের সংখ্যা কমিয়ে যাচ্ছে- যা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পাখি শিকার ও এর প্রভাব বিভিন্ন এলাকায় শীতের পাখি শিকার একটি সাধারণ ঘটনা। মাংসের লোভে এবং শখের বশে পাখি শিকার পরিবেশের জন্য একটি বড় ক্ষতির কারণ। এটি শুধু জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে না, বরং খাদ্য শৃঙ্খলেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। পাখি শিকার বন্ধে সরকারের কঠোর আইন প্রণয়ন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। সংরক্ষণে করণীয় শীতের পাখিদের সংরক্ষণে আমাদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নিচে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ উলেস্নখ করা হলো : ১. জনসচেতনতা বৃদ্ধি : পাখি শিকার বন্ধে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করতে হবে। ২. জলাভূমি সংরক্ষণ : জলাভূমি ও হাওড় রক্ষা করে পাখিদের জন্য নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করা। ৩. আইন প্রয়োগ : পাখি শিকার ও তাদের বসতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা। ৪. গবেষণা : পাখিদের গতিবিধি, খাদ্যাভ্যাস, এবং পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে সমাধান খোঁজা। ৫. প্রকৃতিপ্রেমীদের অংশগ্রহণ : পরিবেশপ্রেমীদের সম্পৃক্ত করে শীতের পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া। পর্যটন এবং শীতের পাখি শীতের পাখিরা পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিষয়। হাওড় অঞ্চলে বা জলাভূমিতে পাখিদের ঝাঁকবাঁধা উড়ান এবং তাদের কলরব প্রকৃতিপ্রেমীদের মুগ্ধ করে। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়, সিলেটের হাকালুকি হাওড় এবং পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় প্রতি বছর শীতের পাখি দেখতে প্রচুর পর্যটক ভিড় করেন। এর মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। শীতের পাখিরা আমাদের কী বার্তা দেয়? শীতের পাখিরা আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একটি সুযোগ করে দেয়। তারা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার গুরুত্ব এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এই অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে এবং তাদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে আমরা প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারি। শীতের পাখিরা আমাদের প্রকৃতির অনন্য রত্ন। তারা দূরদেশ থেকে আমাদের দেশে আসে, প্রকৃতিতে সৌন্দর্য যোগ করে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। কিন্তু মানবসৃষ্ট হুমকির কারণে তাদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। আমাদের সবার উচিত এই অতিথি পাখিদের সংরক্ষণে সচেতন হওয়া এবং প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখা।