শীতকাল প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় আমাদের মধ্যে। ঠান্ডা হাওয়া, সকালের ধোঁয়াটে কুয়াশা আর উষ্ণ পোশাকের আমেজ মনে স্বস্তির অনুভূতি জাগায়। তবে শীতের এই মিষ্টি আবহাওয়াই আমাদের ত্বকের জন্য নানা রকম সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুষ্ক বাতাস, স্বল্প আর্দ্রতা এবং শীতল তাপমাত্রা ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা শুষে নেয়। ত্বক হয়ে পড়ে শুষ্ক, রুক্ষ ও প্রাণহীন। ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখতে এবং শুষ্কতা থেকে রক্ষা করতে শীতকালে ত্বকের সঠিক যত্ন নেওয়া একান্ত জরুরি। আজকে আমরা শীতকালে ত্বকের যত্নের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, যা ত্বককে সুন্দর, মোলায়েম ও স্বাস্থ্যবান রাখতে কাজে আসবে বলে আশা করছি।
শীতে ত্বকের প্রধান সমস্যা
শীতকালে ত্বকের প্রধান সমস্যা হলো শুষ্কতা। ত্বক দেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ এবং এর সুস্থতা আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। শীতকালে বাতাসের আর্দ্রতা কমে যায়, ফলে ত্বকের প্রাকৃতিকভাবে তেল উৎপাদন কমে যায় এবং ত্বকের উপরিভাগ ফেটে গিয়ে ত্বক তার স্বাভাবিক কোমলতা হারায়। বিশেষ করে মুখ, হাত এবং পায়ের মতো অংশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে শীতকালের এই সমস্যাগুলো প্রতিরোধের জন্য সঠিক যত্ন এবং নিয়ম মেনে চললে ত্বককে সুস্থ রাখা সম্ভব।
ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন, গরম পানি পরিহার করুন
এই সময় ত্বকের যত্নে প্রথম ও প্রধান কাজ হলো ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করা। ময়েশ্চারাইজার ত্বকের জন্য বিশেষ ঢাল হিসেবে ব্যবহার হয়। শুষ্ক ত্বকের জন্য প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত, যা ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে আর্দ্রতা ধরে রাখে। অ্যালোভেরা জেল, নারকেল তেল এবং শিয়া বাটার এগুলো শীতকালে ত্বকের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। তবে ময়েশ্চারাইজার অবশ্যই নিয়ম মেনে ব্যবহার করতে হবে। ত্বক পরিষ্কার করার পর এবং গোসলের পর ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করলে এটি সঠিকভাবে কাজ করে এবং ত্বক দীর্ঘসময় আর্দ্র থাকে। শীতকালে অনেকেই গরম পানি দিয়ে গোসল করতে ভালোবাসেন। মনে রাখবেন, গরম পানি ত্বকের বড় শত্রম্ন। গরম পানি ত্বকের প্রাকৃতিক তেল ধুয়ে ত্বককে শুষ্ক করে তোলে। সেক্ষেত্রে হালকা উষ্ণ পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে দীর্ঘসময় ধরে গরম পানিতে থাকা যাবে না। ত্বকের শুষ্কতা কমাতে গোসলের পরে ত্বকে ভালো মানের ময়েশ্চারাইজার লাগাতে হবে।
সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন
শীতকালে সূর্যের আলো প্রায়ই কম দেখা যায়। ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেকেই ভাবেন সানস্ক্রিন ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। শীতকালেও সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি ত্বকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আলট্রাভায়োলেট রশ্মি ত্বকের কোলাজেন উপাদান ভেঙে দেয়। ফলে ত্বক তার নমনীয়তা হারায় এবং বয়সের ছাপ পড়ে। তাই শীতকালেও প্রতিদিন সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। বিশেষত যারা দিনের বেলা বাইরে বেশি সময় কাটান, তাদের অবশ্যই একটি ভালোমানের এসপিএফ-যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত।
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন
শীতকালে খুব একটা পিপাসা না থাকার কারণে পানি পান করার পরিমাণ কমে যায়। এটিও ত্বকের শুষ্কতার অন্যতম কারণ। ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে দিনে অন্তত ৮-১০ গস্নাস পানি পান করুন। এর পাশাপাশি ফলের রস, সুপ এবং আর্দ্রতা সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। দেহের অভ্যন্তরীণ হাইড্রেশন ত্বকের উজ্জ্বলতা ও কোমলতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
সময়োপযোগী খাবার গ্রহণ করুন
সঠিক ও সময়োপযোগী খাদ্য নির্বাচন ও গ্রহণ ত্বকের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। শীতকালে ত্বকের যত্নে খাদ্যতালিকায় ভিটামিন সি, ই এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার যোগ করুন। কমলা, আমলকী, রঙিন শাকসবজি এবং টমেটো বা গাজরের মতো পুষ্টিকর খাবার ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা ধরে রাখে। এ ছাড়া ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, বাদাম এবং তিলের বীজ ত্বকের শুষ্কতা দূর করে এবং ত্বককে ভেতর থেকে পুষ্টি জোগায়।
লিপ বাম ব্যবহার করুন
শীতকালে ঠোঁট ফাটা খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। ঠোঁটের ত্বক শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল, তাই এটি খুব দ্রম্নত শুষ্ক হয়ে যায়। ঠোঁটকে মোলায়েম এবং স্বাস্থ্যকর রাখতে লিপ বাম ব্যবহার করুন। নারকেল তেল, পেট্রোলিয়াম জেলি বা মধু ঠোঁটে প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে। রাতে ঘুমানোর আগে ঠোঁটে লিপ বাম লাগালে তা সারারাত ঠোঁটকে আর্দ্র রাখে এবং ফাটা রোধ করে।
সপ্তাহে একদিন এক্সফোলিয়েশন করুন
শীতকালে ত্বকে মৃত কোষ জমে গিয়ে ত্বককে মলিন এবং রুক্ষ করে তোলে। সেক্ষেত্রে ত্বককে সতেজ এবং মসৃণ রাখতে সপ্তাহে একবার হালকা এক্সফোলিয়েশন করতে হবে। সতর্কতার সঙ্গে এক্সফোলিয়েশন করতে হবে, যেন অতিরিক্ত স্ক্রাবিংয়ের ফলে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল উঠে না যায়। মধু, দই বা ওটমিলের মতো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে স্ক্রাব তৈরি করে ব্যবহার করলে তা ত্বকের জন্য নিরাপদ এবং কার্যকর।
প্রতিরাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান
ঘুম ত্বকের কোষ পুনরুদ্ধার এবং নতুন কোষ তৈরি হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ত্বক ক্লান্ত এবং শুষ্ক হয়ে পড়ে। প্রতিরাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম ত্বকের কোষগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং ত্বকের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে সাহায্য করে। যারা পর্যাপ্ত ঘুমান, তাদের ত্বক সাধারণত বেশি উজ্জ্বল এবং স্বাস্থ্যবান থাকে।
ত্বকের জন্য সহনীয় পোশাক পরুন
শীতকালে পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ত্বকের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার কথা মাথায় রাখতে হবে। উলে বা সিনথেটিক পোশাক সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে না আনাই ভালো। এগুলো কারও কারও ত্বকে জ্বালাপোড়া বা অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে। এর পরিবর্তে সুতি কাপড়ের পোশাক পরিধান করা উচিত, যা ত্বকের জন্য আরামদায়ক এবং ভেন্টিলেশন উপযোগী।
স্কিন কেয়ার রুটিন মেনে চলুন
নিয়মিত একটি সঠিক স্কিনকেয়ার রুটিন মেনে চলুন। শীতকালের উপযোগী করে তৈরি ক্লিনজার, ময়েশ্চারাইজার এবং সিরাম ব্যবহার করুন। প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি প্রসাধনী পণ্য ত্বকের জন্য বেশি উপকারী। এতে কোনো ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ বা সিনথেটিক উপাদান থাকে না। এ ছাড়া রাতে ঘুমানোর আগে মেকআপ ভালোভাবে পরিষ্কার করা এবং নাইট ক্রিম ব্যবহার করা ত্বকের জন্য খুবই উপকারী।
শীতকাল যতটা আনন্দের, ততটাই ত্বকের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং সময়। তবে সঠিক যত্ন এবং নিয়ম মেনে চললে সময়টিকে ত্বকের জন্য সৌন্দর্যের মৌসুমে পরিণত করা সম্ভব। ত্বককে শুষ্কতা, ফাটা বা রুক্ষতা থেকে রক্ষা করার জন্য নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার, সানস্ক্রিন প্রয়োগ, হাইড্রেশন ধরে রাখা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখার বিকল্প নেই। শীতের হাওয়ায় ত্বকের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে এই ছোট ছোট যত্নের অভ্যাস হতে পারে আপনার ত্বকের জন্য মহামূল্যবান উপহার।