অল্পবয়সি শিশুদের মধ্যে অনেক সময় হঠাৎ করে স্কুলে যাওয়া নিয়ে চরম নেতিবাচক অনুভূতি অথবা ভীতি তৈরি হয়। একে বলে স্কুল ফোবিয়া (ঝপযড়ড়ষ চযড়নরধ)। অনেকে একে স্কুল রিফিউজালও বলেন। বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের প্রকাশ হিসাবে শিশু স্কুলে যেতে খারাপ বোধ করতে পারে বা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। অনেকের মতে সেপারেশন অ্যাংজাইটির বা বাবা- মা থেকে বিচ্ছিন্নতার ভয় থেকে সৃষ্ট উৎকন্ঠার কারণে শিশু স্কুল ফোবিয়ায় ভুগতে পারে। ফলে শিশু স্কুল বা স্কুলের মতো পরিস্থিতিতে যেতে ভয় পায়। অনেক সময় দেখা যায় যে, শিশুরা বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে উদ্বেগে থাকে। পরিবারের নানান ধরণের অশান্তি থাকতে পারে। বাবা-মায়ের একজনের হয়তো রাগ বেশী বা একজন হয়তো মাদকাসক্ত। বাবা-মা প্রায়ই ঝগড়া-ঝাটিতে লিপ্ত থাকেন। শিশু ভয় পায় যে, সে যখন স্কুলে থাকবে তখন বাবা ও মা একে অপরকে আহত করে ফেলবেন। হয়তো মা চলে যাবেন। তাকে আর কখনো দেখা যাবেনা। প্রতিবেশীরা তাদের পরিবারের সদস্যদের আক্রমণ করবে। জলোচ্ছ্বাস বা অগ্নিকান্ডে বাড়ি ও পরিবারের সদস্যরা কোন মারাত্মক পরিণতিতে পড়বে। মোট কথা এধরণের উদ্বেগমূলক চিন্তার বশবর্তী হয়ে শিশু বাড়িতে অবস্থান করে তার মতো করে সমস্যার একধরণের সমাধান করতে চায়। ফলে স্কুলে যেতে চায়না। স্কুল ভয় পায়।
এধরণের বাচ্চারা সাধারণতঃ অতি সংবেদনশীল, লাজুক, ম্রীয়মান, উদ্বেগাক্রান্ত ও আবেগীয় ভাবে অপরিপক্ক হয়। তাদের মধ্যে নিজেদের প্রতি আস্থার ঘাটতি থাকে (অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস কম থাকে) ও একটি পরিব্যাপ্ত অসম্পূর্ণতার অনুভূতি তাদের মধ্যে থাকে। তারা তাদের ভয়ের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য সাধারণতঃ বাবা-মায়ের প্রতি অতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে ও তাদের এই আবেগগুলোর সাথে কিভাবে খাপ খাওয়াতে হয় তা জানেনা। পরিবার ও বাড়ি ত্যাগ করে কোথাও যাবার সময় তাদের উৎকন্ঠা বেড়ে যায়। প্রথম দিকে ছোট-খাট কোন বিষয় নিয়ে শিশু অভিযোগ করে। যেমন- স্কুলের শিক্ষক তার পছন্দ হয়নি, এই স্কুল ভালনা, তার সহপাঠিরা তাকে খেলায় নিতে চায়না ইত্যাদি। পরে শিশু স্কুলে যেতে চায়না, কাঁদে, স্কুলে দেরিতে যায়। একসময় স্কুলে যাওয়া একদম বন্ধ করে দেয়। স্কুলে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করলেও শিশু উৎকন্ঠার শিকার হয় ও শারীরিক ভাবে অসুস্থ বোধ করে।
১% থেকে ৫% স্কুলগামী শিশুদের স্কুল ফোবিয়া বা স্কুল রিফিউজাল থাকে। পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা বেশী দেখা যায়। তবে বড়দের মধ্যেও কিছু শিশুর স্কুল ফোবিয়া দেখা যায়। পরিবারের একমাত্র সন্তান, ছোট সন্তান বা প্রায়ই রোগে ভুগে এমন শিশুদের মধ্যে এই সমস্যা বেশী দেখা দেয়।
স্কুল ফোবিয়া (ঝপযড়ড়ষ চযড়নরধ) আছে এমন শিশুরা প্রায় অসুস্থতার অভিযোগ করে। তাদের মাথা ব্যথা করে, পেটে ব্যথা হয়, গলায় টক টক লাগে, গলায় কিছু আটকে আছে এমন অনুভূতি হতে পারে, তারা প্রায়ই কাঁদে। স্কুলে যেতে হবেনা এটি নিশ্চিত হলে অসুস্থতার অনুভূতি সাধারণতঃ চলে যায়। স্কুলে থাকার সময় শিশু বাবা-মাকে নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করে। মাঝে মাঝে সে প্রচন্ড রাগ করে। প্রায়ই স্কুলে দেরিতে যায়, স্কুলে অনুপস্থিত থাকে, বিশেষতঃ গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে অনুপস্থিত থাকে, যেমন, পরীক্ষার সময়, বিশেষ কোন ক্লাশের সময় স্কুলে যায়না। স্কুলে গেলেও প্রায়ই অসুস্থতার কারণে বাসায় চলে যাবার অনুমতি চায়। এক পর্যায়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধই করে দেয়।
স্কুল ফোবিয়ার কারণ
নানা কারণে স্কুল ফোবিয়া দেখা দেয়। যখন শিশুর জীবনে কোন পরিবর্তন আসে তখন এটি হতে পারে। যেমন- প্রথম স্কুল শুরুর সময়, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্কুল শুরুর সময়, বাবা-মা যে কোন একজনের মৃত্যুর পর বা বাবা-মার মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের পর পর এটি হতে পারে। এমনকি পোষা প্রাণীর মৃত্যুর পরও স্কুল ফোবিয়া শুরু হতে পারে। কোন ছুটির পর ক্লাশে যাবার সময়, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ক্লাশ শুরুর করার পর পর এটি হতে পারে।
নতুন পরিবেশের সাথে এবং নতুন সহপাঠিদের সাথে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হলে স্কুল ফোবিয়া তৈরী হতে পারে। যেমন- শিশুর হয়তো টয়লেট ট্রেনিং ঠিকমতো হয়নি। টয়লেট করতে বাবা-মার সাহায্য লাগে। এখন স্কুলের টয়লেটে যেতে সে অস্বস্তি বোধ করতে পারে। বাসায় হয়তো ফ্ল্যাট প্যান আর স্কুলে হাই কমোড। অথবা স্কুলের স্টাফ তাকে বার বার বাথরুমে যাওয়া নিয়ে বিরক্ত হলো। অথবা ক্লাশের ঘরটিতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস নেই। ক্লাশে আসতে হলে এমন একটি সিড়ি ব্যবহার করতে হয় যা শিশু ভয় পায়। ইত্যাদি করণেও স্কুল ফোবিয়া হতে পারে।
শিশু হয়তো কোন পরীক্ষা, কোন নির্দিষ্ট ক্লাশ, কোন দলগত উপস্থাপনা এড়িয়ে যেতে চাচেছ। এর সূত্র ধরেই তার স্কুল ফোবিয়া শুরু হতে পারে।
শিশু হয়তো অন্য শিশুদের সাথে আন্তঃক্রিয়া এড়াতে চাচ্ছে। সে হয়তো খুব লাজুক, তার মধ্যে হয়তো সোস্যাল ফোবিয়া বা সামাজিক ভীতি আছে। ফলে অন্য সহপাঠি ও শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ভয় পেয়ে সে এগুলো এড়াতে গিয়ে স্কুলকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। সে নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষদের মধ্যে থাকতে ভয় পাচ্ছে। ফলে সে স্কুলে যেতে চাইছেনা।
সে স্কুলের বাইরে তাৎপর্যপূর্ণ কারো মনোযোগ চাচ্ছে। স্কুলে না গেলে যদি সে বাবা-মায়ের একজনের পূর্ণ মনোযোগ ও সঙ্গ পায় তবে স্কুল ফোবিয়া হতে পারে। বাবা-মায়ের মধ্যে একজন যদি বলতে থাকেন যে শিশু তাদের থেকে দূরে থাকাকালীন কোন বিপদে পড়তে পারে তবে স্কুলের পরিবেশে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে ও স্কুল বাদ দিতে চাইতে পারে।
স্কুলে না গেলে যদি শিশু কম্পিউটার গেমস, টেলিভিশন দেখা বা এধরণের মজার ও চিত্তাকর্ষক কাজে ব্যস্ত থাকে, যদি তাকে এই সময়টা পড়তে না হয় তবে স্কুলে না যাবার বিষয়টি আরো পাকাপোক্ত হয়।
শিশুর উপর বাবা-মা ও শিক্ষকদের এমনকি শিশুর নিজেরই অনেক উচ্চাশা আছে যে সে পরীক্ষায় ভাল করবে। কিন্তু ভালো করার ক্ষেত্রে যদি তার ক্ষমতার ঘাটতি থাকে বা আত্মবিশ্বাস কম থাকে তবে শিশুর মনে উৎকন্ঠা ক্সতরী হয়। পরীক্ষায় বা মূল্যায়ণে খারাপ করার ভয় তাকে জেঁকে ধরে। ফলে স্কুল ফোবিয়া হয়।
শিশু যদি ক্রমাগত পরীক্ষায় খারাপ করে, তার যদি বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতা বা কোন স্পেসিফিক লার্নিং ডিজঅ্যবিলিটি থাকে (ফলে পড়ায় খারাপ করতে থাকবে) তবে সে স্কুলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ও ভয়ে ভুগে স্কুলে যেতে অস্বীকার করতে পারে।
স্কুলের বা ক্লাশের অন্য বাচ্চারা যদি শিশুকে মারে, লাঞ্ছিত করে, ভয় দেখায় তবে শিশু স্কুলে যেতে চায়না। শিশু অধিক মোটা, অধিক চিকন, কম উচ্চতা সম্পন্ন, বা অধিক কালো ইত্যাদি যেসব বৈশিষ্ট্য অন্যদের মতো নয় তার কারণে সে লাঞ্ছিত হতে পারে। যদি কোন কারণে শিক্ষক বা অন্য কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী একই ভাবে শিশুকে মারেন বা লঞ্ছিত করেন তবেও শিশু স্কুলে যেতে চাইবেনা।
শিশু তার নিজের পরিবার, বাবা-মা ও ভাই-বোন নিয়ে উদ্বেগে ভুগে স্কুলে না এসে বাসায় থাকতে চাইতে পারে। বাসায় পারিবারিক অশান্তি, ঝগড়া-ঝাটি থাকলে বা প্রতিবেশীদের সাথে খুব বেশী পরিমাণে মনোমালিন্য থাকলে শিশুর মধ্যে পরিবার নিয়ে উৎকন্ঠা বেড়ে যেতে পারে।
বিভিন্ন মানসিক রোগের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে স্কুল ফোবিয়া আসতে পারে। শিশু হয়তো উদ্বেগ, বিষনড়বতা, মনোদৈহিক রোগ, কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার, সেপারেশন অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার, জেনারালইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে ভুগছে। ফলে সে স্কুল ভয় পাওয়া ও এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলো। শিশুর হয়তো ঘুমের রোগ রয়েছে। যেমন- ডিলেইড স্লিপ ফেজ সিন্ড্রোম (ডিএসপিএস) এর ফলে শিশু সহজে ঘুমাতে পারেনা। ফলে সে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনা ও স্কুলে যেতে পারেনা।
মো. জহির উদ্দিন, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্ট, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।