বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
ঐতহ্যিরে বাংলাদশে

ইংরেজদের অত্যাচারের নীরব সাক্ষী চৌগাছার নীলকুঠি

আসাদুজ্জামান মুক্ত, চৌগাছা (যশোর)
  ৩০ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০
যশোরের চৌগাছায় অবস্থিত ইংরেজদের অত্যাচারের নীরব সাক্ষী নীলকুঠি -যাযাদি

মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেই কপোতাক্ষ নদের কোল ঘেঁসে নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইংরেজ বর্গীদের অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণের স্মৃতি যশোর জেলার চৌগাছার নীলকুঠি। কুঠিয়ালদের অত্যাচার, নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে নিজেদের বাঁচা মরার তাগিদে তখন চৌগাছার কৃষকরা অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছিল। ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ তা সবার আগে এই চৌগাছার মাটি থেকেই শুরু হয়ে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। যে কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে নীল চাষের ইতিহাসে যশোরের চৌগাছাকে নীল বিদ্রোহের সুতিকাগার বলা হয়ে থাকে। সেই ইংরেজদের শাসনও আজ নেই, নীল চাষও নেই। আছে শুধু স্মৃতিচিহ্ন নীলকুঠি।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতেই মূলত বৃহত্তর যশোরে প্রথম নীল চাষ শরু হয়। ১৮৬০ সাল থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত নীলচাষ এ অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করে। যশোর জেলায় সর্বপ্রথম নীল কারখানা স্থাপন করেন মিস্টার বন্ড। ১৫৯৫ সালে তিনি যশোর রূপদিয়াতে একটি নীলকুঠি তৈরি করেন। সেখানে অনেক বেশি নীল উৎপন্ন হওয়ার কারণে ওই এলাকার নাম হয় নীলগঞ্জ। ইংরেজদের যেসব নীলকুঠি ছিল তার মধ্যে চৌগাছা নীলকুঠি ইতিহাস খচিত। কারণ, নীল বিদ্রোহের শুরু এখান থেকে।

কোম্পানির অন্যায় আইন চাপিয়ে দেওয়ার কারণে নীল চাষ কৃষকদের জন্য লাভজনক ছিল না। প্রতি বিঘায় একজন চাষির নীল চাষ করতে খাজনা বাবদ ১০ আনা, বীজ বাবদ চার আনা, চাষ করতে এক টাকা, বুনতে চার আনা, নীলগাছ কাটাসহ অন্যান্য বাবদ মোট দুই টাকা ১৪ থেকে ১৫ আনা খরচ হতো। এছাড়া কুঠিয়ালদের কাছ থেকে অগ্রিম স্ট্যাম্প বাবদ কেটে নেওয়া হতো দুই আনা। সব মিলিয়ে চাষিদের নীল উৎপাদন করে লাভের পরিবর্তে লোকসান গুনতে হতো বেশি। ১৮১০ সালের দিকে নীল চাষিদের উপর অত্যাচার অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। এ কারণে চৌগাছার জমিদার হেমপ্রসাদ ইংরেজদের চিঠি লিখেছিলেন 'বাংলার কৃষক কৃতদাস নহে'।

যত দূর জানা যায়, ১৮৫৮ সালে চৌগাছার মাটি থেকেই মূলত নীল বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। এ বিদ্রোহে যারা সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে চৌগাছার দিগম্বর ও সহোদর পিতম্বর বিশ্বাস, ঝিকরগাছার অমৃত বাজারের শিশির কুমার ঘোষ, চুয়াডাঙ্গার মথুরানাথ আচার্য ও চন্ডিপুরের হরি রায় অন্যতম। সে সময় ইলেশমারী কুঠির পাশে গুয়াতলিতে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ হয়। কৃষকরা জোটবদ্ধ হয়ে ভারতের বাগদা থানা আক্রমণ করে সেখান থেকে ছয়টি একনলা বন্দুক ছিনিয়ে আনে। চৌগাছায় বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটার পর একে একে তা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষকরা ঝিকরগাছার বেনেয়ালীতে ইংরেজদের কুঠিতে সশস্ত্র আক্রমণ করে। নীল বিদ্রোহের কারণে চৌগাছার দিগম্বর ও পিতম্বর ওরফে বিষ্ণুচরণের বিরুদ্ধে হুলিয়া দেয় ইংরেজ সরকার। এ সহোদর ইংরেজদের অপমান সহ্য করতে না পেরে দাঁত ভাঙা জবাব দিতে একর পর এক আক্রমণ চালায়। ১৮৬৮ সালে বিদ্রাহের কারণে কুঠিয়ালরা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। নির্যাতিত নীলচাষিদের দীর্ঘমেয়াদি দুর্বার আন্দোলনের ফলশ্রম্নতিতে ১৯০৫ সালে চিরতরে ভারতবর্ষ হতে নীল চাষ উঠে যায়।

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে চৌগাছার নীল বিদ্রোহের কথা। অত্যাচারীদের রক্তাক্ত ইতিহাস বুকে ধারণ করে কালের নীরব সাক্ষী হয়ে কপোতাক্ষ নদের পাশে চৌগাছার কুঠিপাড়ায় ইংরেজদের সেই নীলকুঠি স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<117231 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1