বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অমরকীর্তি পাবনা শহরের প্রাসাদোপম তাঁড়াশ বিল্ডিং

ম আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা
  ১৭ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০
পাবনার জমিদার রায়বাহাদুর বনমালী রায় প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক তাঁড়াশ ভবন -যাযাদি

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ আমাদের এই দেশ। সেই ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন পাবনার তাঁড়াশ বিল্ডিং। প্রাচীন জনপদ পাবনায় এটি নির্মাণ করেছিলেন নামকরা জমিদার রায়বাহাদুর বনমালী রায়। শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত এই প্রাচীন, সুদৃশ্য ও বিশাল ভবনটি এখনো মাথা উঁচু করে স্পর্ধায় দাঁড়িয়ে আছে তার অক্ষত অবয়ব নিয়ে। আশপাশে ফল ও ফুলের গাছে এটি সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। আব্দুল হামিদ সড়কের এই ভবনের দেখভাল করছে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।

তথ্যমতে, বগুড়া জেলার চান্দাইকোণার কাছে 'কোদলা' গ্রামে এক ঘর কায়স্থ জমিদার ছিলেন, এই জমিদারই তাঁড়াশের রায়বংশের পূর্বপুরুষ বাসুদেব। তাঁড়াশের এই পরিবার ছিল পাবনা জেলার সবচেয়ে বড় জমিদার। বাসুদেব নবাব মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব বিভাগে চাকরি করে প্রতিষ্ঠা করেন রাজবাড়ী। নবাব মুর্শিদকুলি খান বাসুদেবকে ভূষিত করেন 'রায় চৌধুরী' খেতাবে। তার এস্টেট ছিল প্রায় ২০০ মৌজা নিয়ে। এই রায় বংশের বনমালী রায় ও বনওয়ারী লাল রায়ের নির্মাণ ঐতিহ্যবাহী বনমালী ইনস্টিটিউটও।

জানা যায়, ১৯৪২ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধের আতঙ্কে এ জমিদার পরিবার তাদের পাবনা শহরে নির্মিত ঐতিহাসিক তাঁড়াশ বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। পাবনা অঞ্চলের সর্ববৃহৎ জমিদার নির্মিত তাদের অমরকীর্তি পাবনা শহরের তাঁড়াশ বিল্ডিং আজও তাদের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। আদিতে বনওয়ারী লাল ফরিদপুর থানার ডেমরাতে বসতি স্থাপন করেন এবং কালক্রমে এই স্থানের নাম হয় বনওয়ারীনগর। তাদের নির্মিত শহরের ভবনটি তাঁড়াশ রাজবাড়ী নামেও পরিচিত। পাবনা প্রাসাদোপম ভবনটির সম্মুখভাগ দ্বিতলবিশিষ্ট এবং চারটি সুডৌল বৃত্তাকার স্তম্ভ সহযোগে প্রাসাদের দ্বিতলের কক্ষটি নির্মিত। প্রাসাদের সামনে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের শেষ প্রান্তে প্রবেশ ফটকটির দুই পাশে দুটি করে চারটি স্তম্ভ এবং মাঝখানে বিশাল আকৃতির অর্ধবৃত্তাকার খিলানে প্রবেশপথটি সৃষ্ট। দৃষ্টিনন্দন প্রবেশপথটি সহজেই সবার নজর কাড়ে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ রীতির প্রভাবে নির্মিত তাঁড়াশ জমিদার বাড়ি। তাঁড়াশের জমিদার রায় বাহাদুর বনমালী রায়ের অর্থানুকূল্যের স্মৃতি নিয়ে জেগে আছে এই বিল্ডিং।

তাঁড়াশ জমিদারদের পাবনা শহরে নির্মিত প্রাসাদ ভবনের সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য বৈশিষ্ট এর প্রবেশ তোরণ। ভবনটি আয়তাকৃতির এবং এর আয়তন দৈর্ঘ্যে ৩০.৪০ মিটার (১০০ ফুট) এবং প্রস্থ ১৮.২৮ মিটার (৬০ ফুট)। চারটি কোরিনথিয়ান স্তম্ভের উপরে আকর্ষণীয় দ্বিতল গাড়ি বারান্দা সহজেই পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁড়াশ জমিদার ভবনের দুই পাশে দুটি বর্ধিত অঙ্গ সংযুক্ত রয়েছে এবং সর্বত্র অর্ধ-বৃত্তাকৃতির খিলান সুষমভাবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। তাঁড়াশ রাজবাড়ী অনেক আগে থেকে সরকারি দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় সমসাময়িককালে নির্মিত অন্যান্য জমিদার বাড়ি থেকে সুরক্ষিত আছে এবং সম্প্র্রতি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষিত ইমারতের তালিকাভুক্ত হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, অধিকাংশ সময়ে বিল্ডিংয়ের মূল ফটকের গ্রিলের গেট সামান্য খুলে রাখা হয়। আর মূল তোরণের সামনে অর্থাৎ আব্দুল হামিদ সড়কে সিএনজিচালিত অটো গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করছে অটো সিএনজিগুলো। ভেতরে সুন্দর সুন্দর পাকা করা সরু পথ। আশপাশে ফল ও ফুলের গাছসহ নানা বাহারি ফুলের সমাহার। প্রবেশপথের বামেই রয়েছে টিনশেড বিল্ডিং। যেটি ব্যবহার করা হতো পৌর ভূমি কর অফিস হিসেবে। সম্প্রতি অফিসটি ওই স্থান থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত মানুষগুলো মূল ভবনের নিচে ছায়াঘেরা পরিবেশে বসে জিরিয়ে নেন। আশপাশের জেলাগুলো থেকে এই অবকাঠামো দেখতে একবারের জন্য হলেও আসেন দর্শনার্থীরা। দেখতে আসা কয়েকজন দর্শনার্থীর সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, আগের অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে এখনকার ডিজাইনে অনেক অনেক তফাত রয়েছে। তাদের দাবি, তাঁড়াশ বিল্ডিং রাস্তায় যাওয়া-আসার সময়ে দেখেছি রিকশা থেকে। কিন্তু কখনো কাছে গিয়ে নিবিড়ভাবে দেখা হয়নি। এটি দেখতে এসে সত্যিই অভিভূত হয়েছি বিল্ডিংটির নকশা ও কারুকার্যে। এত সুন্দর বিল্ডিং কেবল প্রাচীন সময়কার নির্মাণই জানান দেয়।

স্থানীয়দের দাবি, তাঁড়াশ বিল্ডিংয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে এবং এর সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধিতে সামনে থেকে অটো-সিএনজি স্ট্যান্ড সরিয়ে দিতে হবে। বহিরাগতদের প্রবেশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মাদকাসক্তদের আনাগোনা প্রতিরোধ করতে মূল ফটকে নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে