শাহজাদপুরের রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর সৃষ্টিশীলতার এক জীবন্ত প্রতীক

প্রকাশ | ২৫ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

ম এমএ জাফর লিটন, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ)
'ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো, তোমার মনেরও মন্দিরে।'- সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বিচ্ছেদ স্মরণ করে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তার বিখ্যাত 'যাচনা' কবিতাটি। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রবাদ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অফুরান অভিজ্ঞতার উৎস বাংলাদেশ। এসেছিলেন জমিদারি করতে। কিন্তু কান পেতে শুনেছেন বাংলার মাটি-জল-হাওয়ার গল্প। শিলাইদহে পেয়ে বসেছিল বাউলের সুরে মানুষ খোঁজার নেশা। আর শাহজাদপুর তাকে দিয়েছে জীবনের অন্য স্বাদ। এখানে এসে পেয়েছেন আত্মোপলব্ধি। সেই উপলব্ধিই এখানকার প্রকৃতি আর মানুষকে তার কাছে এনে দিয়েছে। এখানে বসেই তিনি তার অসংখ্য অনবদ্য সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, শাহজাদপুরের জমিদারি এক সময় নাটোরের রানি ভবানীর নামে ছিল। ১৮৪০ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর নিলামে মাত্র তের টাকা দশ আনা দিয়ে জমিদারি কিনে নেন। এরপর থেকেই সেখানে শুরু হয় জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের কর্তৃত্ব। ১৮৯০ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাদপুরে যাতায়াত ছিল। জমিদারি দেখাশোনার কাজে মাঝে মাঝে আসতেন এবং সাময়িকভাবে বসবাস করতেন। টানা দুই মাস এখানে অবস্থান করেছেন। এখানে তিনি রচনা করেছেন অনেক উঁচুমানের সাহিত্য। এর মধ্যে রয়েছে সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, কল্পনা। ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে পোস্টমাস্টার, ব্যবধান, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, ছুটি, অতিথি। ছিন্ন পত্রাবলির মধ্যে ৩৮টি পত্রও এখানেই লিখেছিলেন কবি। নাটকের মধ্যে রয়েছে বিসর্জন, প্রবন্ধের মধ্যে পঞ্চভূত। কবি শিলাইদহ থেকে বজরায় বড়াল নদের রাউতারায় এসে সেখান থেকে পালকিতে চড়ে কাচারিবাড়িতে আসতেন। তিনি এই এলাকায় দুধ ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গো-চারণভূমি, জলমহালগুলো বিনা পয়সায় এলাকার নিকারি সম্প্রদায় ও দরিদ্রদের মধ্যে প্রদান করেছিলেন। তার পালকিবাহক আট বাগদি পরিবারকে দিয়েছেন থাকার জায়গা। ১৮৯৭ সালে কবির বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি ভাগাভাগি করে দিলে কাকা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুর, বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ এবং কবি নিজে পতিসরের দায়িত্ব পান। এরপর তিনি আর শাহজাদপুরে আসেননি। শাহজাদপুরের অংশ চলে যাওয়ার কয়েক মাস পরে ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ৮ আশ্বিন রবীন্দ্রনাথ পতিসর যাওয়ার পথে তার প্রিয় শাহজাদপুরে আর একবার এসেছিলেন। কাচারিবাড়ি ঘুরে দেখা যায়, এটি ইন্দো ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ৩১ দরজাবিশিষ্ট একটি দোতলা ভবন। প্রায় দশ বিঘা জমির উপর নির্মিত ভবনটির দৈর্ঘ্য ২৬.৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০.২০ মিটার এবং উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার। ভবনটির প্রতি তলায় সিঁড়িঘর বাদে বিভিন্ন আকারের সাতটি ঘর রয়েছে। ভবনটির উত্তর-দক্ষিণে একই মাপের বারান্দা। বারান্দায় গোলাকৃতি থামের উপরাংশের অলংকরণ, বড়মাপের দরজা, জানালা ও ছাদের উপরের দেয়ালে পোড়ামাটির কাজ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভবনটিতে রবীন্দ্রনাথের জীবনভিত্তিক আলোকচিত্র এবং ব্যবহৃত আসবাবপত্র নিয়ে রবীন্দ্র-স্মৃতি জাদুঘর করা হয়েছে। জাদুঘরটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহার্যসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে সোফা, পালকি, খাট, চায়ের কেটলি, খড়ম, চিনামাটির জগ, চিনামাটির পানির ফিল্টার, পিয়ানো, শ্বেত পাথরের গোলটেবিল, চিঠি লেখার ডেস্কসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী। জাদুঘরে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ২৮ ভাদ্রে লেখা শত বছরের পুরনো একটি চিঠি রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই চিঠি জাদুঘরটিকে সমৃদ্ধ করেছে। চিঠিটি নওগাঁ থেকে সংগৃহীত। ভবনটির পশ্চিমে বকুল গাছের গোড়ায় বৃত্তাকার বাঁধানো একটি মঞ্চ আছে। এটি 'রবীন্দ্র মঞ্চ' নামে পরিচিত। তৎকালীন সরকার ১৯৬৯ সালে এই কাচারিবাড়িকে পরিচ্ছন্ন করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় এনে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৯ সালে কাচারিবাড়ির পশ্চিম আঙ্গিনায় ৫০০ আসনবিশিষ্ট উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে নান্দনিক অডিটোরিয়াম নির্মাণ করে। প্রতি বছর ২৫, ২৬ ও ২৭ বৈশাখ কবির জন্মজয়ন্তী সরকারিভাবে উদযাপন করা হয় নানা অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে।