শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রমিক সংকট ও জোয়ারের পানিতে চাপা পড়েছে কৃষকের হাসি!

জমিতে পানি জমে পচে যাচ্ছে ধান
ম স্বদেশ ডেস্ক
  ১৮ মে ২০২২, ০০:০০

চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও শ্রমিক সংকটে তা ঘরে তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন কৃষক। সেই সঙ্গে পাহাড়ি ঢল ও কালবৈশাখীতে জমিতে পানি জমে পচে যাচ্ছে ধান। সব মিলিয়ে এবার বিপাকে পড়েছেন বোরো চাষিরা। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) : এবার ৩ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেছেন গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বেলাই বিল পাড়ের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব মো. আজম আলী। কিন্তু কাটার আগেই হঠাৎ জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে জমিতে থাকা ধান। এমন অবস্থায় এর আগে তিনি কখনো পড়েননি।

কৃষক আজম আলী জানান, ধান পানিতে ডুবে তার সব শেষ হয়ে গেছে, এখন পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।

উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের বেলাই বিল পাড়ের চলিস্নশোর্ধ্ব আরেক বাসিন্দা মোশারফ আকন্দ বলেন, বেলাই বিলের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে তার জমি। ৩ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেন। ফলনও বেশ ভালোই হয়েছিল। গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টিতে পানি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি হঠাৎ করে পানি দ্রম্নত বেড়ে যাওয়ায় ধান কাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাছাড়া চারদিকে একই সমস্যা, তাই শ্রমিক পাওয়াও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। যে কারণে পাকা ধান ঘরে তোলা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। মাত্র আধা বিঘা জমির ধান কাটতে পেরেছেন, বাকি আড়াই বিঘার ধান সব পানির নিচে। এ বছর পরিবার নিয়ে চলা কষ্টকর হয়ে যাবে।

জানা গেছে, বিল বেলাইয়ের সুবিশাল প্রান্তর জুড়ে শুধুই ধানের আবাদ করা হয়। এই বিলে শুধু একবার ধান চাষ করা যায়। যে কারণে এটাকে এক ফসলি জমি বলা হয়। এই বিল থেকে উৎপাদিত ধান ও সবজি গাজীপুর জেলারসহ আশপাশের এলাকার চাহিদা পূরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তবে এবার অসময়ের জোয়ারের পানিতে চাপা পড়েছে কৃষকের মুখের হাসি। বিলের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ।

সরেজমিন দেখা যায়, খাল দিয়ে পানির প্রবল স্রোতে ধেয়ে আসছে। কয়েকদিন আগেও যেখানে শুকনো ছিল আজ সেখানে পানিতে টইটুম্বুর। ধান থেকে চাল না হলেও অন্তত খড় যেন বাঁচানো যায় এ চিন্তা করে কৃষকরা নৌকা দিয়ে বিলের বিভিন্ন প্রান্তের কাঁচা, আধাপাকা ধান কেটে নিয়ে আসছেন। খড় সংগ্রহ করা না গেলে পুরো একটি বছর গবাদিপশু পালন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, 'আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। তবে এটা যেহেতু সারাদেশের সমস্যা তাই অনুমোদন হতে একটু সময় লাগবে। তবে আশা করা যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সরকারিভাবে কিছু সহযোগিতা পাবে।'

চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) : দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের ফলন ভালো হলেও গত দুইদিনের ভারি বর্ষণে অনেক কৃষকের সোনালি স্বপ্ন ডুবে গেছে পানির নিচে। এমনিতেই সার, তেল, কীটনাশক ও শ্রমিকের খরচ বাড়তি। ধান পানিতে ডুবে যাওয়ায় কর্তনের শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। একই সঙ্গে ধান কাটা-মাড়াই করা মজুরদের লাগামহীন দাবিতে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। মিলছে না কাঙ্ক্ষিত দামও।

উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, দুই দিনের টানা বর্ষণে বৃষ্টির পানিতে ধানের জমি তলিয়ে গেছে। পুরোপুরি পেকে যাওয়ায় জমিতে ধান ফেলেও রাখতে পারছেন না তারা। এ অবস্থায় হতাশ হয়েও বেশি দামে ধান কাটা-মাড়াইতে বাধ্য হয়েছেন কৃষকরা। অন্যদিকে, বাড়ির উঠান ভিজে গিয়ে কর্দমাক্ত হওয়ায় পাকা সড়কে অথবা খেলার মাঠে ধান শুকাচ্ছেন তারা। ধান ভিজে যাওয়ার সুযোগকে সদ্ব্যবহার করছেন মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা। তারা কম দামে ধান কিনতে কৌশলে কৃষককে অনবরত ভুল বোঝাচ্ছেন।

আব্দুলপুর ইউনিয়নের নান্দেড়াই গ্রামের কৃষক মহসিন আলী ও আমিনুল ইসলাম জানান, কয়েক ঘণ্টার টানা বর্ষণে ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। তলিয়ে যাওয়া ধান কেটে আনা ও মাড়াই করতে অতিরিক্ত ২ হাজার টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। বৃষ্টির আগে বিঘাপ্রতি যেখানে খরচ ছিল সাড়ে ৭ হাজার টাকা। বর্তমানে তা ৮-৯ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। রোদ না থাকায় ওই ধান শুকাতে না পেরে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

ধান চুক্তিতে কাটানো মজুর সর্দার আসফাকুর রহমান বাবু বলেন, জমি বাড়ির নিকটবর্তী হলে বিঘাপ্রতি ৮ হাজার টাকা ও দূরের জমি হলে দূরত্ব অনুযায়ী দাম চাওয়া হচ্ছে।

উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ জোহরা সুলতানা বলেন, উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা ১৯ হাজার ৪৯০ হেক্টর। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৩০ হাজার ৬৩ টন এবং চালের লক্ষ্যমাত্রা ৮৫ হাজার ৮৪২ মেট্রিক টন। তিনি কৃষকদের একটু ধৈর্যধারণ করে উৎপাদিত ধান সংরক্ষণের অনুরোধ করেছেন।

নালিতাবাড়ী (শেরপুর) : শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে ধান কাটা শ্রমিক সংকট উত্তরণে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ২৩টি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে প্রতি শ্রমিকের রোজ ১৪ থেকে ১৫শ' টাকা মজুরি ও দুই বেলা খাওয়া দিয়ে ধান কাটানো হয়েছে। হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটা শুরুর পর কৃষকদের হতাশা কেটে আগ্রহ বেড়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় প্রতি একর ধান কাটা ১৫ থেকে ১৯ হাজার টাকায় চুক্তি নিয়ে ধান কাটার কাজ করেছিলেন ধান কাটা শ্রমিকরা। বর্তমানে ২৩টি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন দিয়ে সাড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকায় ধান কাটা হচ্ছে।

উপজেলার রূপনারায়নকুড়া ইউনিয়নের কৃষ্ণ দেবীপুর গ্রামের আলী মুর্তুজ জানান, হারভেস্টার মেশিন দিয়ে এক একর জমির ধান কাটিয়েছেন ৯ হাজার টাকায়। হারভেস্টার মেশিন দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১০ একর জমির ধান কাটা যায়।

মেশিন দিয়ে ধান কাটতে থাকায় কোনো কোনো গ্রামে ১৫শ' টাকা মজুরির স্থলে ধান কাটা শ্রমিকের ১২শ' থেকে ১৩শ' টাকা ও দুই বেলা খাওয়া দিয়ে ধান কাটানো হচ্ছে।

কৃষক আজহারুল ইসলাম জানান, ৩ থেকে ৪ দিন আগে ১৫শ' টাকা মজুরি ও দুই বেলা খাওয়া দিয়ে ধান কাটিয়েছেন। ধান মাজরা পোকার আক্রমণে ও শিলে ক্ষতি হওয়ায় প্রতি একরে ৩০ থেকে ৩৫ মণ হারে ধান পাচ্ছেন। ধানের ফলন খুবই কম, খরচ উঠবে না।

নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ২২ হাজার ৭৫০ হেক্টর বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও পুরনো ২৮ জাতের ধান বেশি আবাদ করায় ও পুরনো জাতের ধানের রোগ ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় কিছুটা ফলনে সমস্যা হবে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর কবির জানান, ১৩ মে পর্যন্ত ৫০ পারসেন্ট ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। আধুনিক জাতের ধান একরে ৬০ থেকে ৭০ মণ হারে মাড়াই করছেন কৃষক।

রাজস্থলী (রাঙামাটি) : চলতি বোরো মৌসুমে রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। ফলে ব্যস্ততা বেড়েছে কৃষান-কৃষানির।

জানা যায়, উপজেলার রাইখালী এবং চিৎমরম ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ধানের ফলন হয়েছে। রাইখালী ইউনিয়নের রিফিউজি পাড়া, বড়খোলা পাড়ায় এবং চিৎমরম ইউনিয়নের আমতলী পাড়ায় সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ধানের ব্যাপক সমারোহে ভরপুর সবুজ প্রান্তর। জমিতে ধানের গন্ধে ম' ম' করছে চারপাশ। কৃষান-কৃষানি ব্যস্ত ধান কাটায়। তবে গত বছরের মতো এবারও কৃষকরা ধান কাটার শ্রমিক সংকটে ভুগছেন বলে কৃষক উথোয়াই মং মারমা এবং কৃষক ইসমাইল হোসেন জানান।

কাপ্তাই উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মধুসূদন দে জানান, এ বছর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৩২৬ হেক্টর জমিতে বোরোর ব্যাপক ফলন হয়েছে। এ বছরের কৃষি বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৬০ মেট্রিক টন। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা ছেড়ে যেতে পারে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন।

ইতিমধ্যে উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়নে ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। এবার ধানের ব্যাপক ফলন হওয়ায় কৃষকরা আশানুরূপ ফলন গোলায় তুলতে পারবেন বলে মাঠ পর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা অংছাই মং চৌধুরী এবং অনিমেষ প্রকাশ বড়ুয়া আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

গাংনী (মেহেরপুর) : মেহেরপুরের গাংনীতে বেশ কয়েকদিন কখনো মাঝারি, কখনো ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। কৃষকরা ক্ষেত থেকে বোরো ধান কাটা মাড়াই শুরু করেছেন। বাড়তি মজুরি দিয়েও শ্রমিকের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই অনেক কৃষক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বোরো ধান ঘরে তোলার কাজ করছেন। আবার অনেকেই আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি দিয়ে কাটা মাড়াই করছেন। তবে গেল বছরের তুলনায় বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে কৃষকদের।

উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে কৃষকদের ধান নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে দেখা গেছে। যুগিরগোফা গ্রামের আবু বক্কর বলেন, অন্যান্য বছর এক বিঘা ধান কাটার পর, মাড়াই করে ঘরে তুলতে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ হতো। কিন্তু বৃষ্টিপাতের কারণে এবার খরচ প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। তিনি বলেন, এখন এক বিঘা জমির ধান কাটতেই লাগছে ছয় হাজার টাকা। পানি-কাদার জন্য বাড়তি গাড়ি ভাড়াও লাগছে। ধান মাড়াই করে ঘরে তুলতে আরও বাড়তি তিন হাজার টাকা লাগছে।

উপজেলা কৃষি অফিসের হিসাব মতে, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় সাত হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। তিন হাজার হেক্টর ধান কাটা হয়েছে। বাকি সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা মাড়াইয়ের অপেক্ষায়। ৫০ শতাংশের বেশি জমির ধান কৃষকরা ঘরে তুলেছেন। বৃষ্টির কারণে বাকিরা সমস্যায় পড়েছেন। আসানির প্রভাবে বৃষ্টিপাতের কারণে অন্তত দুই হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতির মুখে পড়েছে।

দুই বিঘা জমিতে এ বছর বোরো আবাদ করেছেন কামারখালি গ্রামের কৃষক আনারুল ইসলাম। মাঝারি ও ভারী বৃষ্টির কারণে তার পুরো জমির ধান পানির নিচে চলে গেছে।

কুঞ্জনগর গ্রামের চাষি আক্কাচ আলী জানান, গেল বছর ধানকাটা লেবারদের হাজিরা ছিল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এ বছর এক লাফে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দাবি করছে তারা। তাই বাড়ির লোকজন নিয়েই কাজ শুরু করেছেন।

গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার লাভলী খাতুন জানান, উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার থেকে অনেক বেশি বোরো চাষ হয়েছে। এখন বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিলে কিছুই করার নেই। ইন্টারনেটের যুগে আবহাওয়া দেখে ধান কাটা শুরু করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে