বিদু্যৎ বিভ্রাটে জনজীবন অতিষ্ঠ

প্রকাশ | ০৬ জুলাই ২০২২, ০০:০০

ম স্বদেশ ডেস্ক
বিভিন্ন স্থানে বিদু্যৎ বিভ্রাট (লোডশেডিং) তীব্র আকার ধারণ করেছে। ঘন ঘন বিদু্যৎ যাওয়া-আসা যেন হয়ে পড়েছে নিত্যদিনের ঘটনা। কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়াই সারা দিন বিদু্যৎ সরবরাহ বন্ধ রাখছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এভাবে দিনে-রাতে অন্তত ১৫ থেকে ২০ বার বা তার চেয়েও বেশি লোডশেডিংয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিদু্যৎ বিভাগ বলছে জাতীয় গ্রিডে সমস্যাজনিত কারণে এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- গাংনী (মেহেরপুর) প্রতিনিধি জানান, এ উপজেলায় শহরাঞ্চলে বিদু্যৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ। গ্রামাঞ্চলে ২৪ ঘণ্টায় মাত্র তিন ঘণ্টা বিদু্যৎ সরবরাহ থাকছে। বিদু্যৎ বিতরণে বৈষম্যের এমনি অভিযোগ তুলেছেন খোদ গ্রামের বিভিন্ন পোল্ট্রি ফার্মের মালিক ও হাস্কিং মিল মালিকরা। পলস্নী বিদু্যৎ সমিতির গাংনী জোনাল অফিসের হিসাব অনুযায়ী, গাংনীতে ১১ মেগাওয়াট বিদু্যতের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে পিক ও অফ পিক আওয়ারের জন্য বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র সাড়ে চার মেগাওয়াট। যা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। ফলে পালাক্রমে বিভিন্ন ফিডারে বিদু্যৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে লোডশেডিংয়ের মাত্রা অনেক বেড়েছে। এলাকাবাসী জানান, এমনিতেই অনাবৃষ্টি, তাপদাহের সঙ্গে পড়ছে গুমোট গরম। তার উপর লোডশেডিং। তিন ঘণ্টা পরপর ১০-১৫ মিনিটের জন্য বিদু্যৎ আসছে। আবার কখনও সারাদিনের জন্য বিদু্যৎ বন্ধ রাখা হচ্ছে। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিমুলতলা গ্রামের পোল্ট্রির মালিক কাউসার জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে লোডশেডিংয়ের কারণে তার ফার্মের ২১০টি মুরগি মারা গেছে, যার একেকটির ওজন অন্তত চার কেজি। মোটা অংকের টাকা লোকসান হয়েছে। অনেকেই পানির দরে মুরগি বিক্রি করে দিচ্ছে। একই কথা জানালেন সহড়াবাড়িয়া গ্রামের পোল্ট্রি ফার্মের মালিক ফজলুর রহমান। তিনি আরও জানান, গত তিন-চারদিন বিদু্যতের অভাবে অক্সিজেন না পেয়ে ১৪৪টি মুরগি মারা গেছে। ফলে বাজারে ১০০ টাকা কেজি দরে সব বিক্রি করে দেওয়া হয়। এতে ৪৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। হাড়াভাঙ্গা তোফাজ্জেল রাইস মিল মালিক জানান, কোরবানির ঈদ দুয়ারে কড়া নাড়ছে। এখন কাজের চাপ। লোডশেডিংয়ে ধান ভাঙানো ছাড়াও মসলাপাতি গুঁড়া করা সম্ভব হচ্ছে না। মেহেরপুর পলস্নী বিদু্যৎ সমিতির গাংনী জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আবুল কাশেম জানান, 'এখানে ১১ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও সরবরাহ পাচ্ছি সাড়ে ৪ মেগাওয়াট। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে গ্যাস স্বল্পতার কারণেই এরকম লোডশেডিং হচ্ছে। এটা জাতীয় সমস্যা। আরও কিছুদিন এরকম সমস্যা হতে পারে।' মধুপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিদু্যতের লোডশেডিং তীব্র আকার ধারণ করেছে। দিনে-রাতে অন্তত ১৫ থেকে ২০ বার বা তার চেয়েও বেশি লোডশেডিংয়ের হয়রানির শিকার হচ্ছে এলাকাবাসী। দীর্ঘদিন ধরে এমন অব্যবস্থাপনার শিকার হলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না গ্রাহকরা। গত কয়েক মাস ধরে বিদু্যতের এ সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিদু্যৎ না থাকায় তীব্র গরমে মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ। আর সমস্যার প্রতিকার চাইতে বিদু্যৎ অফিসের দেওয়া মোবাইল নম্বরে কল দিয়েও সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ গ্রাহকদের। পৌর এলাকার নূরুল ইসলাম বলেন, অফিসের দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে ফোন করে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না, প্রায় সময়ই ফোনটি ধরে না। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে নষ্ট হচ্ছে ফ্রিজ, টিভি, ফ্যানসহ বৈদু্যতিক বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। কদিমহাতীল বাজারের আফসার উদ্দিন নামের এক দোকানদার জানান, দিনে প্রায় ১৬ ঘণ্টাই বিদু্যৎ থাকছে না। ফলে ফ্রিজের কোমল পানীয় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চাপড়ির লোকমান নামে এক গ্রাহক জানান, রমজান মাসেও প্রায় প্রতিদিনই ভোরে বিদু্যৎ চলে যেত যা এখনো চলছে। এতে ভ্যাপসা গরমে বয়োবৃদ্ধ নারী, পুরুষ-শিশুসহ সবার কষ্ট হচ্ছে। এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ পলস্নী বিদু্যৎ সমিতি-১ এর মধুপুর জোনাল অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ডিজিএম) আবু মো. ইয়াহিয়া আকন্দ জানান, 'চাহিদার চেয়ে কম সরবরাহ থাকায় মধুপুরে লোডশেডিং হচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টির মৌসুমে মেন্টেনেনসের কারণে কিছু সমস্যা হয়ে থাকে।' রামপাল (বাগেরহাট) প্রতিনিধি জানান, বাগরহাটের রামপাল উপজেলায় রাত-দিন জুড়ে দফায় দফায় বিদু্যৎ বিভ্রাটের কারণে স্বাভাবিক জনজীবন কার্যত ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে নামাজে দাঁড়ালেই বিদু্যৎ নিয়ে যাওয়াটা এক রকম নিয়মেই পরিণত হয়েছে। নামাজের সময় বিদু্যৎ নিয়ে যাওয়ায় মুসলিস্নরা গরমে নামাজ পড়তে বিড়ম্বনা পোহাচ্ছেন। বিষয়টি বিদু্যৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের জানানো হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। ঘন ঘন বিদু্যৎ বিভ্রাটের কারণে হিমায়িত মাছ ব্যবসায়ী, স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশি ক্ষতি হচ্ছে। উপজেলার ফয়লাহাট, ভাগা, গৌরম্ভা, ঝনঝনিয়া, বাবুরবাড়ি, গিলাতলা, পেড়িখালিসহ বিভিন্ন এলাকায় হিমায়িত চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ বেচাকেনা হয়ে থাকে। বিদু্যতের লোডশেডিংয়ের কারণে বরফ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আর এ কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফয়লাহাট ও তার আশপাশের কয়েকটি এলাকায় গভীর নলকূপ থেকে পাইপ লাইনের সাহায্য মোংলা বন্দর, ইপিজেডসহ বিভিন্ন এলাকায় খাবার পানি সরবরাহ করা হয়। বিদু্যৎ না থাকায় পানি সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিদু্যতের কি পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিদু্যৎ অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, রামপালে গ্রাহক অনুপাতে দিনে ৫.২৩ মেগাওয়াট, রাতে ৭.৪ মেগাওয়াট বিদু্যতের চাহিদা রয়েছে। ঘাটতি থাকায় বাধ্য হয়ে রাতে লোডশেডিং করতে হয়। তারাকান্দা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে লোডশেডিং তীব্র আকার ধারণ করলেও কোনো প্রকার প্রতিকার পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। সমস্যার প্রতিকার চাইতে বিদু্যৎ অফিসের দেওয়া মোবাইলে কল দিয়েও সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। উপজেলার ব্যবসায়ী সাগর তালুকদার বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে নষ্ট হচ্ছে ফ্রিজ, টিভি, ফ্যানসহ বৈদু্যতিক বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। সদর ইউনিয়নের আলমগীর নামে এক গ্রাহক জানান, লোডশেডিংয়ের ফলে আমনের বীজতলায় সমস্যা হচ্ছে। এছাড়াও তীব্র এই গরমে সংস্কারের নামে এক দুই দিন পর পর বিদু্যৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা। এ ব্যাপারে ফুলপুর তারাকান্দা নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানি দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদু্যৎ উৎপাদনের সমস্যা হচ্ছে। চাহিদার চেয়ে কম থাকায় তারাকান্দা ফুলপুরে লোডশেডিং হচ্ছে। তিতাস (কুমিলস্না) প্রতিনিধি জানান, কুমিলস্নার তিতাস উপজেলাকে শতভাগ বিদু্যতায়িত এলাকা হিসেবে গত দুই বছর আগে ঘোষণা করেছে পলস্নী বিদু্যৎ সমিতি-৩। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে এ এলাকায় চলছে লোডশেডিংয়ের মহোৎসব। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে গ্রাহকরা বিদু্যৎ পাচ্ছেন মাত্র ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা। কড়িকান্দি গ্রামের মনিরুল হক জানান, শুক্রবার থেকে দৈনিক গড়ে প্রায় ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা বিদু্যৎ থাকছে না। গরম বাড়ায় আমাদের প্রচুর ভোগান্তি হচ্ছে। রাতে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিদ্রাহীনতার কান্নায় আশপাশ ভারি হচ্ছে। কড়িকান্দি বাজারের মুন্সি স্টোরের মালিক জামাল মুন্সি জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে গত দুইদিনে তার প্রায় দশ হাজার টাকার আইক্রিস নষ্ট হয়েছে। কিছু করার নেই। বাতাকান্দি বাজারের মেইল মালিক ফরিদ উদ্দিন জানান, সামনে কোরবানির ঈদ। মানুষ তাদের মরিচ, হলুদসহ অন্যান্য জিনিস ভাঙানোর জন্য মেইলে নিয়ে আসছেন। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে ঠিকমতো ডেলিভারি দিতে পারছেন না। এ বিষয়ে কুমিলস্না পলস্নী বিদু্যৎ-৩ এর তিতাস সাব-জোনাল অফিসের এজিএম গোলজার হোসেন জানান, 'এটি শুধু একা তিতাসের সমস্যা নয়; সারা বাংলাদেশে একই অবস্থা। আমরা যতটুকু বিদু্যৎ পাচ্ছি ততটুকু সরবরাহ করছি।'