রাতে সুবাস ছড়িয়ে ভোরে বেদনা বুকে নিয়ে ঝরে শিউলি ফুল

প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
মাদারীপুরের শিবচর ও চুয়াডাঙ্গার দামুরহুদায় শিউলি ফুলের গাছ -যাযাদি
শরৎ গিয়ে প্রকৃতিতে বিরাজ করছে হেমন্ত। তবুও চারপাশে তার রাজত্ব। বলছি সাদা বসন আর জাফরান রঙে মোড়া শুভ্রকুমারী শিউলির কথা। অতি সাধারণ এক ফুল শিউলি। রাতের আঁধারে নিজের রূপ পুরোটা ছড়িয়ে, বাতাসে বিলিয়ে দেয় নেশা লাগানো সুবাস। আর ভোরের আলো ফুটলেই ঝরে পড়ে সাদা-কমলা গালিচা তৈরি করে। কার সঙ্গে যেন অভিমান কিংবা লুকোচুরি করে এই শিউলি। শিবচর (মাদারীপুর) থেকে এসএম দেলোয়ার হোসাইন জানান, শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা শিউলি ফুলের অপূর্ব দৃশ্য গ্রামের পথে প্রান্তরে ও বসতবাড়িতে প্রায় দেখা যায়। এই ফুলের সৌন্দর্য আর মিষ্টি ঘ্রাণে বাগান, উন্মুক্ত স্থান ও বসতবাড়ির আঙিনা মেতে ওঠে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও মুগ্ধ হয়েছেন শিউলির রূপে। লিখেছেন অনেক গান ও কবিতা। আগে যত্রতত্র শিউলি গাছ দেখা গেলেও নগর সভ্যতার কারণে এখন আর তেমনটি চোখে পড়ে না। শিউলি ফুল হারিয়ে যেতে বসেছে। নতুন করে এখন আর যত্ন করে শিউলি গাছ কেউ বুনে না। তবুও অনাদর-অবহেলায় বেড়ে ওঠা শিউলি ফুলের গাছ চোখে পড়ে মাঝেমধ্যেই। জানা যায়, শিউলির ভেষজ গুণও অনন্য। স্বাদে তিতা হলেও মৌসুমি জ্বর, গলা বসা, ক্রিমি, জন্ডিস ও খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত সমস্যায় দু-তিন চামচ পাতার রস সেবন উপকারী। এ ছাড়া অতীতে খাবারের রং হিসেবে শিউলি বোঁটার ব্যবহার ছিল। শিউলি এই উপমহাদেশেরই নিজস্ব উদ্ভিদ। আদি নিবাস মধ্য ও উত্তর ভারতে। বৈজ্ঞানিক নাম ঘুপঃধহঃযবং ধৎনড়ৎঃৎরংঃরং। তেমন বড় নয়। ডালপালা প্রচুর। বাকল পুরু, ফ্যাকাশে রঙের। সরু শাখার দুই পাশে বিপরীত দিকে ঘন পাতার বিন্যাস। শীতে ও বসন্তে পাতা ঝরে যায়। গ্রীষ্মে নতুন পাতায় শাখা ভরে ওঠে। ফুল ফোটা শুরু হয় শরতের প্রথম থেকে। তবে হেমন্তও এই ফুল ফোটে। কার্তিকের প্রথম দিকে ফুল কিছুটা কম হয়, তবে মাসের শেষ দিকে ফুলের সংখ্যা বাড়ে। শিউলির অন্য নাম শেফালী। এই দুটি নাম বারবার এসেছে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায়। উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের তনয় রায়দের বাড়িতে গিয়ে শিউলি ফুলের গাছে অপরূপ দৃশ্য মিলে। তিনি বলেন, 'আমাদের বাড়িতে একটি বড় পুরাতন শিউলি ফুলের গাছ আছে। প্রচুর ফুল ফুটে। প্রতিদিন সকালে শিশুরা দল বেঁধে শিউলি কুড়ায়। এ দৃশ্য দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়। এই ফুল আমরা ও আশপাশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা-অর্চনায়ও ব্যবহার করেন। এবং সকালে সনাতন ধর্মের মেয়েরা ফুল নিতে আসে।' সাংবাদিক অপূর্ব জয় রায় বলেন, 'শরৎ বিদায় নিলেও ফুলটিকে উপহার হিসেবে হেমন্তের কাছে রেখে গেছে। হেমন্ত মানেই প্রভাতের শিশিরভেজা শিউলি, ঝিরিঝিরি বাতাসে দোল খাওয়া ধবধবে কাশবন, পদ্ম-শাপলা-শালুকে আচ্ছন্ন জলাভূমি। গাছে গাছে শিউলি ফোটার দিন। আমরাও ছোটবেলায় শিউলি কুড়িয়ে মালা গাঁথতাম।' পুরাণের সে স্বর্গের ফুল হোক কিংবা রাজকন্যা পারিজাতের পরাজিত প্রেম- শিউলির প্রতি আমাদের ভালোবাসা থাকবে সবসময়। হয়তো কোনো নারী শিউলির মালা গুঁজে দেবেন খোঁপায় কিংবা কোনো তরুণ খুব ভোরে শিউলি কুড়াবে প্রিয়তমার জন্য। দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে হাসমত আলী জানান, শিউলি ফুলকে 'দুঃখের ফুল' বলা হয়। দিনের আলোতে এ ফুল তাদের উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে। শিউলিকে অনেকে শেফালী নামে ডাকে। এটি রাতে ফুটে সকালেই ঝরে যায়। শিউলি ফুলের সৌন্দর্য আর মিষ্টি ঘ্রাণে বাগান, উন্মুক্ত স্থান ও বসতবাড়ির আঙিনা মেতে ওঠে। সকালে শিশিরমাখা শিউলি ফুল দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। গ্রামের ছোট ছোট মেয়েরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে শিউলি কুড়াতে যায়। সবুজ পাতার মধ্যে এক-একটি শিউলি ফুল ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয় সৌন্দর্যের। কোনো কোনো ধর্মের বিশ্বাস শিউলি স্বর্গের ফুল। এই ফুল নিয়ে এমন গল্প আছে- এক রাজকুমারী সূর্যকে ভালোবেসে না পেয়ে আত্মহত্যা করে ফুল গাছে পরিণত হয়। সকাল বেলায় যেন সূর্যের মুখ না দেখতে হয়, তার জন্য সূর্য উঠার আগেই ঝরে পড়ে গাছ থেকে। রাজকন্যার নাম ছিল পারিজাতিকা। এ জন্য শিউলির আরেক নাম পারিজাত। আগে যত্রতত্র শিউলির গাছ দেখা গেলেও নগর সভ্যতার কারণে এখন আর তেমনটি চোখে পড়ে না। নতুন করে এখন আর যত্ন করে শিউলি গাছ কেউ রোপণ করে না। তবুও অনাদর-অবহেলায় বেড়ে ওঠা শিউলি ফুলের গাছ চোখে পড়ে মাঝে মধ্যেই। তাইতো এখনো শিউলি তলা ভোর বেলা পলিস্ন বালিকারা ফুল কুড়াতে ভিড় জমায়। দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা বলেন, শিউলির ছয়টি শুভ্র সাদা পাপড়ি। বৃন্তটি কমলা রঙের টিউবের মতো। এটি নরম ধূসর ছাল বা বাকলবিশিষ্ট হয়। গাছ লম্বায় ১০ মিটারের মতো হয়। গাছের পাতা ৬ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বা এবং সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী সাজানো থাকে। সৌন্দর্য উপভোগ ছাড়াও শিউলির আরও ব্যবহার আছে। ফুলটির বোঁটাগুলো শুকিয়ে গুঁড়ো করে হালকা গরম পানিতে মেশালেই তৈরি হয় চমৎকার একটি রং। এ ছাড়া বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে শিউলির বীজ, পাতা ও ফুল ব্যবহার করা হয়।