সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে দেশ

বিশ্বস্বাস্থ্য দিবস আজ

প্রকাশ | ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি, কালাজ্বর নির্মূলসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। শিশু ও মাতৃমৃতু্যর হার উলেস্নখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও স্বাস্থ্যসেবায় অভূতপূর্ব অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ থেকে 'সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড' এবং গেস্নাবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমু্যনাইজেশন (গ্যাভি) থেকে 'ভ্যাকসিন হিরো' খেতাব পেয়েছেন। এতে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে। তবে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জন, বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা সূচক ও স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তিমূলকতা সূচকে এখনো বেশ পিছিয়ে। দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ রয়েছেন কোনো না কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ও কমিয়ে আনা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৈশ্বিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যসূচকে দেশের বর্তমান অবস্থান উন্নয়ন, উন্নয়ন চিন্তা ও উন্নয়ন স্বপ্নের সঙ্গে মানানসই নয়। পাশাপাশি সূচকগুলোর বৈশিষ্ট্য যে বার্তা দেয়, তা হচ্ছে- স্বাস্থ্য গঠন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি শুধু স্বাস্থ্য খাতের ওপরই নির্ভর করে না। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ ৭ এপ্রিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্বস্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- 'স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিতে, কাজ করি একসাথে'। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের নেতৃত্বে নেওয়া এক সমীক্ষায় জানা যায়, বছরে সারা বিশ্বে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের মৃতু্য হয়। আকস্মিক দুর্ঘটনায় অনেকে মারা যান বটে, তবে ৪৫০টির বেশি রোগ ও আঘাতজনিত কারণে ভুক্তভোগী হয়ে অধিকাংশ মানুষের মৃতু্য ঘটে। কোনো কোনো রোগে কী অবস্থায় মানুষের মৃতু্য ঘটছে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য এই সমীক্ষা পরিচালিত হয়। বিশ্বের প্রায় ৫০০ বিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্যবিদ, রোগতত্ত্ববিশারদ, পরিসংখ্যানবিদ ও গবেষক। ১৯০টি দেশের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তারা সমীক্ষাটি করেন। ওই সমীক্ষার ভিত্তিতে জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট ২০১২ সালে বিশ্বের সব দেশের বিভিন্ন রোগ ও আঘাতের কারণে মানুষের মৃতু্যর বিস্তারিত পরিসংখ্যান প্রথমবারের মতো প্রকাশ করে। সমীক্ষাটিতে দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশে বছরে আনুমানিক ৮ লাখ ৪৭ হাজার মানুষের মৃতু্য ঘটে। আর এর পেছনে আছে ২২৬টি রোগ ও আঘাতের কারণ। মৃতু্যর পেছনে রোগের উৎস নিয়ে এটিই বিশদ তথ্যভিত্তিক সমীক্ষা। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার অর্থায়নে পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেশব্যাপী স্বাস্থ্যঝুঁকির এসব বিষয় জানা গেছে। সংক্রামক রোগগুলোর মোট ৬২টি আছে বাংলাদেশের ব্যাধিতালিকায়। ৬২টি ব্যাধিকে সাতটি বর্গে ভাগ করা হয়েছে- এইচআইভি-এইডস ও যক্ষ্ণা; ডায়রিয়া, নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও অন্যান্য সাধারণ সংক্রামক ব্যাধি; অবহেলিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ ও ম্যালেরিয়া; মাতৃরোগ; নবজাতকের রোগ; অপুষ্টিজনিত রোগ এবং অন্যান্য সংক্রামক; মাতৃ, নবজাতক ও অপুষ্টিজনিত রোগ। অবহেলিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ ও ম্যালেরিয়ার বর্গে ইয়োলো ফিভার ছাড়া আর সবক'টির প্রাদুর্ভাবই বাংলাদেশে আছে। অসংক্রামক রোগের পালস্না সবচেয়ে বেশি ভারী। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, অসংক্রামক রোগগুলোর ১০টি বর্গ। এই বর্গগুলোতে যত রোগ আছে, তার ১৩০টিতে বাংলাদেশে মানুষের মৃতু্য হয়। এসবের মধ্যে আছে ক্যানসার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, অস্থিসংক্রান্ত ব্যাধি, সিরোসিস ও অন্যান্য যকৃতের রোগ এবং পরিপাকতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র ও দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এসবের সঙ্গে আরও আছে মানসিক রোগ। আঘাত ও দুর্ঘটনাও আছে বহু ধরনের। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে রাজনৈতিক সংঘর্ষে মৃতু্য, এমনকি মৃতু্যদন্ড পর্যন্ত। এসব ধরন আছে মোট ৩৪টি। এই ৩৪ ধরনকে চারটি বর্গে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে সড়ক দুর্ঘটনা; অনিচ্ছাকৃত আঘাত; নিজেকে নিজে আঘাত ও আন্তর্ব্যক্তিক সহিংসতা এবং বলপ্রয়োগ; দ্বন্দ্ব ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড; মৃতু্যদন্ড ও পুলিশি সংঘাত। ওই গবেষণায় দেখা গেয়ে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ৯৯ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা পাঁচটি বিষয়কে স্বাস্থ্যঝুঁকির তালিকায় রেখেছে- উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, ধূমপান, পর্যাপ্ত ফল না খাওয়া এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় না থাকা। কেউ একটি ঝুঁকির মধ্যে আছেন, কেউ একাধিক ঝুঁকির মধ্যে আছেন। বয়স যাদের বেশি, তাদের ঝুঁকিও বেশি। গবেষণা ফলাফল জানা যায়, ১৮ থেকে ৬৯ বছর বয়সি মানুষের ৯৬ শতাংশ প্রয়োজনমতো ফলমূল বা শাকসবজি খান না। একই বয়সি ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত কায়িক পরিশ্রম করেন না বা তারা শারীরিকভাবে যথেষ্ট সক্রিয় নন। এই বয়সি মানুষের ২০ শতাংশ ধূমপান করেন। ২৫ শতাংশ পান-জর্দা ব্যবহার করেন। এই বয়সি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ মদ্যপান করেন। পাশাপাশি ২৪ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। অন্যদিকে দেশের ১০ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। স্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলেন, একটি দেশের স্বাস্থ্যনীতি ছাড়াও সে দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, ওষুধনীতি, বিচারব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ২০০০ সালে প্রথম স্বাস্থ্যনীতি এবং ২০১১ সালে দ্বিতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করা হলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তেমনি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি ২০১২ সালে প্রণীত হেলথকেয়ার ফিন্যান্সিং স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়নে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, 'দেশের সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, ওষুধনীতি, বিচারব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি কোনোটাই স্বাস্থ্য গঠন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অনুকূলে নয়। এ সবকিছু থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে স্বার্থহীন, দূরদর্শী ও গতিময় নেতৃত্ব প্রয়োজন, আজ তার প্রচন্ড অভাব। বেসরকারি খাতের ওপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ, পরিদর্শন ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় জনগণ অর্থ খরচ করে বেসরকারি খাত থেকেও গুণগত স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। তাই জনগণ বিদেশমুখী হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'সরকার এজন্য স্বাস্থ্য খাতের বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নিয়ে একটি কনসোর্টিয়াম প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ ও সহযোগিতা করতে পারে। এটি না হলে দ্বিতীয় উপায়টি হলো, দেশীয় কোনো সামাজিক এন্টারপ্রাইজের উদ্যোগে বেসরকারি খাতে দেশি ও বিদেশি মালিকানায় রেফারেল সুবিধাসহ একটি হাসপাতাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, যা একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডোর অনুসরণ করে পরিচালিত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ মালিকানা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রেও সরকারের সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন।' এদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে ২০৩০ সালের মধ্যে সবর্জনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।