গৌরীপুর ও আজমিরীগঞ্জে মহিলাদের জন্য নির্মিত মার্কেট পুরুষের দখলে!

প্রকাশ | ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) ও আজমিরীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি
নামে মহিলা মার্কেট, রাজত্ব পুরুষের! নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাবলম্বী করার জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উদ্যোগে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে পৌর মহিলা বিপণি বিতান ও গোবিন্দপুর ওমেন্স কর্নার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হলেও নারীদের ভাগ্যে জোটেনি দোকান বরাদ্দ। অবৈধ, নিয়ম-নীতি বহির্ভূতভাবে প্রায় ২২ বছর ধরে এসব মার্কেট পুরুষরা দখল করে আছেন। একাধিক সূত্রে জানা যায়, গৌরীপুর পৌরসভার মধ্যবাজারে ১৬টি দোকান বিশিষ্ট পৌর মহিলা বিপণি বিতান, শ্যামগঞ্জ মহিলা মার্কেট, ভূটিয়ারকোনো নারী দোকান শেড ও গোবিন্দপুর ওমেন্স কর্নার নির্মাণে তৎকালীন সময়ে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় হয়। গোবিন্দপুর ওমেন্স কর্নারটি ২০০২ সালে মইলাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গৌরীপুর পৌরসভার পৌর মহিলা বিপণি বিতানটি ২০০৬ সালে গৌরীপুর পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম হবির কাছে হস্থান্তর করেন। সরজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ১নং মইলাকান্দা ইউনিয়নের গোবিন্দপুর ওমেন্স কর্নারটি ইউনিয়ন পরিষদের কাছে হস্তান্তরের পর ২০০২ সালের ২০ জুন তৎকালীন সাবেক এমপি এএফএম নজমুল হুদা উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে এ মার্কেটটি নিয়ম-নীতি বহির্ভূতভাবে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে নিয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদে হস্তান্তর করা হলেও দোকান বরাদ্দের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়নি। মার্কেটের ১২টি দোকানের মধ্যে ৪-৫টি পুরুষদের দ্বারা পরিচালিত হয়। অন্যগুলো গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এরমধ্যে দোকানের সবগুলো ফ্যান, বিদু্যৎ সরবরাহের সরঞ্জামসহ চুরি হয়ে গেছে। স্থানীয় লোকজনও জানে না এটা 'ওমেন্স কর্নার'। মইলাকান্দা ইউনিয়নে মহিলা মার্কেট (ওমেন্স কর্নার) আছে শুনে বিস্মৃত হন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানান, 'ইউনিয়ন পরিষদে এ মার্কেটের কোনো তথ্য আছে বলে আমার জানা নেই!' ওমেন্স কর্নারটি নারীদের নামে বরাদ্দ দেওয়ার কথা শুনে তাৎক্ষণিক আগ্রহ প্রকাশে করেন পাশের চা দোকানি ফরিদা খাতুন। তিনি বলেন, 'ভাঙা ঘরে দোকান করি, রাতে চোর-ডাকাতের ভয়, তাই দোকানে থাকতে হয়। এ মার্কেটে দোকান পেলে তো নিরাপদে ব্যবসা করতে পারতাম।' দর্জি দোকান নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন পার্শ্ববর্তী শহিদুল ইসলামের স্ত্রী জুয়েল আক্তার। তিনি বলেন, এত বছর পর জানলাম এটা 'আমাদের (নারীদের) মার্কেট।' এ প্রসঙ্গে উপজেলা প্রকৌশলী অসিত বরণ দেব বলেন, নির্মাণের পর মার্কেট স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোনো অনিয়মের অভিযোগ পেলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। অন্যদিকে গৌরীপুর পৌরসভার মধ্যবাজারে পৌর বিপণি বিতানের ১৬টি দোকানেই এখন প্রভাবশালী পুরুষ ব্যবসায়ীদের মালামাল সংরক্ষণের গোডাউন। আর মার্কেটের সামনে তাদের অবৈধ দোকানপাট। মার্কেটটি ২০০৬ সালে উদ্বোধন হয়। এরপর নারী ব্যবসায়ী দোকান খোলায় তৎকালীন সময়ে সামনে বড় মসজিদ হওয়ায় মুসলিস্নদের আপত্তি ও পেছনে মদের দোকান থাকায় মাদকসেবীদের উৎপাত শুরু হয়। এ নিয়ে ২০০৮ সালে সিদ্ধান্ত হয়েছিল 'মার্কেটটির আউটডোর সাইড অফ করে, ইনডোর সাইড করা হবে। যা ১৬ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। মার্কেট প্রসঙ্গে গৌরীপুর পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মদন মোহন দাস জানান, মার্কেটের ১৬টি দোকান বরাদ্দের জন্য সে সময় প্রায় ৬০জন নারী ব্যবসায়ী (উদ্যোক্তা) আবেদন করেন। এরমধ্যে দোকান বরাদ্দের নীতিমালা অনুযায়ী ১৬জনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। বরাদ্দপ্রাপ্ত দোকানীরা সাব ভাড়া দেওয়া ও পৌরসভার নিয়মিত ভাড়া পরিশোধও করেননি। দোকান মেরামতের কারণে তৎকালীন পৌর মেয়র সৈয়দ রফিকুল ইসলাম দোকানদারদের বরাদ্দ ২০১১ সালে বাতিল করে তাদের উচ্ছেদ করেন। সেই দোকানগুলো পরবর্তীতে মৌখিকভাবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে গোডাউনের জন্য ২০২০ সাল পর্যন্ত দেওয়া ছিল। এরপর কীভাবে কারা আছে জানা নেই, তবে তারা অবৈধ দখলদার। সবগুলো দোকান পুরুষদের দখলে আছে! এ মার্কেটে ঠাঁই না পেলেও শহরের মধ্যবাজার, গোবিন্দবাড়ি জিউর মন্দির মার্কেট, বেগ পস্নাজা, সরকারপস্নাজা, কালীপুর দৈনিক বাজার ও শাপলায় ২৯ জন নারী ব্যবসায়ী (উদ্যোক্তা) দোকান পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গৌরীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক মমতাজ বেগম বলেন, নারীদের অগ্রগতি ও তাদেরকে স্বাবলম্বী করার জন্য সরকারের এ উদ্যোগ শুধুমাত্র দোকান বরাদ্দের নীতিমালা না মেনে চলায়, নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের উদ্যোগও বাস্তবায়িত হয়নি। নীতিমালা অনুযায়ী এসব দোকান নারী উদ্যোক্ত বা ব্যবসায়ীদের বরাদ্দ প্রদানের দাবি জানান তিনি। গৌরীপুর পৌরসভার প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুনন্দা সরকার প্রমা বলেন, মহিলা মার্কেটের ফাইল খুঁজে বের করা হচ্ছে। পৌর পরিষদ নেই, পৌর পরিষদ হলেই নীতিমালা অনুযায়ী দোকান বরাদ্দ প্রদানসহ প্রয়োজনী সংস্কার ও মেরামতও করা হবে। আজমিরীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকাইলছেও চৌধুরী বাজারে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নির্মাণ করা মার্কেট দেড় যুগ ধরে দখল করে রেখেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি মিজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া। তার লাগানো তালা ঝুলছে জনগণের ব্যবহারের জন্য তৈরি করা শৌচাগারেও। এদিকে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) বলতে পারছে না- মার্কেট ও শৌচাগার দেখভাল করার দায়িত্ব কার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলজিইডি 'বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় পলস্নী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ২০০৮ সালে তিনটি শেড ও একটি ভবন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নির্মাণ করে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আজমিরীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মিজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া সেটি দখল করে রেখেছেন। সরজমিনে দেখা যায়, বাজারের লঞ্চ টার্মিনাল রোড সংলগ্ন তিনটি শেড ও নারী উদ্যোক্তাদের মার্কেট এবং তার সংলগ্ন দুইটি শৌচাগার রয়েছে। সেখানে চায়ের স্টল ও কাপড়ের দোকান রয়েছে। চা স্টলের ধোঁয়ায় সেডের চালের টিন নষ্ট হয়ে গেছে। একটিতে আনোয়ার মিয়া নামে এক ব্যবসায়ীর ধানের আড়ত। অপর দুটিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়ার ভাতিজা এনামুল হক ভূঁইয়ার সিমেন্টের দোকান। দুটি শৌচাগারও তালাবদ্ধ করে রাখা। এলাকার জনগণ সেটি ব্যবহার করতে পারছেন না। ধান ব্যবসায়ী আনোয়ার মিয়া জানান, কক্ষগুলো মিসবাহ উদ্দিন ভূঁইয়ার অধীনে আছে। তিনি নিজে একটি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়ার ভাতিজা অন্য দুটিতে ব্যবসা করছেন। সাত বছর ধরে এভাবে চলছে। যোগাযোগ করা হলে এনামুল হক ভূঁইয়া জানান, তিনি এখানে ব্যবসা করেন না। এই মার্কেট বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মিজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়ার দখলে। তবে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান মিজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া জানিয়েছেন, কাকাইলছেও বাজারে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কোন মার্কেটই নির্মাণ করা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নারী উদ্যোক্তা জানান, ঘর নির্মাণের পর থেকেই সেটি প্রভাবশালীদের দখলে। তারা ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারছেন না। যোগাযোগ করা হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুয়েল ভৌমিক জানান, তিনি এ ঘটনা সম্পর্কে অবগত না। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।