উন্নয়নের ফুলঝুড়িতে বঞ্চনার কাহিনী
তিতাসে উন্নয়ন বঞ্চিত নয়াচর গ্রাম শিক্ষা ও বাল্যবিয়েতে ব্যাপক প্রভাব
প্রকাশ | ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
মো. শাকিল ভূঁইয়া, তিতাস (কুমিলস্না)
কুমিলস্নার তিতাসে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় একশ' বছর আগে গড়ে ওঠা নয়াচর গ্রামটি উন্নয়নবঞ্চিত। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ফলে ওই গ্রামে বাল্যবিয়ের হার ক্রমে বাড়ছে। বিশেষ করে ৪ কিলোমিটার দূরে ভোট কেন্দ্রে ভোট প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে ওই গ্রামের অধিকাংশ ভোটার। পিছিয়ে পড়া এ গ্রামের অনেকে জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। এ যেন উন্নয়নের নামে ফুলঝুড়িতে বঞ্চনার এক উদাহরণ।
যোগাযোগ : সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, প্রায় একশ' বছর আগে গড়ে ওঠা কুমিলস্নার তিতাস উপজেলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের অবহেলিত গ্রাম নয়াচর। প্রায় দেড় কিলোমিটার লম্বা আধা কিলোমিটারের বেশি প্রস্থ গ্রামটিতে যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। নারান্দিয়া সুইচ গেট থেকে মৎস্য প্রকল্পের পাড় দিয়ে একটি সড়ক থাকলেও সেটি গ্রামের প্রথম অংশ হিরা লালের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। নয়াচর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বারামবাড়ি আরামবাড়ি হয়ে খলিলাবাদ পর্যন্ত পায়ে হাঁটার রাস্তা থাকলেও বারামবাড়ি সামনে খালের ওপর বিশ বছর আগে একটি সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তবে সরকার পরিবর্তনের কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এটি ব্যবহারের অনুপোযোগী। গ্রামের অধিকাংশ মানুষকে খালের পাড় দিয়ে অথবা বাড়ির উঠান ব্যবহার করে যেতে হয়ে নিজ গন্তব্যে।
শিক্ষা : শিক্ষা অর্জন থেকে পিছিয়ে থাকা নয়াচর গ্রামের শিক্ষার আলো জ্বালাতে ১৯৯৪ সালে একই গ্রামের দানবীর ফুল মিয়া ব্যাপারী ও পাশের খলিলাবাদ গ্রামের করম আলী স্কুল নির্মাণের জন্য জমি দান করেন। এর পর গ্রামের মাঝমাঝি স্থানে একতলা স্কুলভবন নির্মাণ হয়। ওই ভবনের ছোট ছোট তিনটি কক্ষে দুই শিফটে চলে খুদে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। প্রাথমিক গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণে গ্রামের শিক্ষার্থীদের অনীহা দেখা গেছে। যার মূল কারণ হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। ওই গ্রামের কাউকে পড়াশোনা করতে যেতে হতো ৭ কিলোমিটার দূরে জুনাব আলী উচ্চবিদ্যালয় কিংবা নারান্দিয়া কলিমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। অথবা ৬ কিলোমিটার দূরে মুরাদনগর উপজেলার পাঁচপুকুরিয়া বাজার উচ্চবিদ্যালয়ে। বর্ষায় নৌকার ভোগান্তি আর শুষ্ক মৌসুমে জমির আইল (পাড়) দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতায় পিছিয়ে পড়ে যায় নয়াচর গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থা। বিশেষ করে এই গ্রামের নারী শিক্ষার হার খুবই নগন্য।
বাল্যবিয়ে : স্থানীয়দের মতে, বর্তমানে নয়াচর গ্রামে প্রায় ছয়শ' পরিবারের দুই হাজার লোক বাস করে। এদের মধ্যে অর্ধেক হিন্দু সম্প্রদায়। পাশাপাশি মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ায় গ্রামে বাল্যবিয়ের প্রবণতা এখনো রয়ে গেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পাঁচ পরিবারের গড়ে তিন কন্যা সন্তান বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে।
ভোটাধিকার : ১৯৯৪ সালে নয়াচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে এ গ্রামের লোকজনকে পাশের গ্রামে গিয়ে ইউপি নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হয়েছে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের পর ইউপি নির্বাচনের ভোট কেন্দ্র এতে স্থানান্তর হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ৪ কিলোমিটার দূরে খলিলাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে যেতে হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক ভোটার ভোটাধিকার থেকে বিরত থাকে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : নয়াচর গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী সেলিম মিয়া বলেন, 'আগে নয়াচর গ্রামটি দাউদকান্দির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০০৪ সালে তিতাস উপজেলা গঠন হওয়ার পর ভেবেছিলাম রাস্তাঘাটসহ সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন হবে। তবে এখনও সেই সুফল আমরা পাচ্ছি না। এলাকার কিছু কৃষক ফসলি জমি কেটে মৎস্য প্রকল্প গড়ে তোলে। সেই প্রকল্পের পাড় দিয়ে আমরা যাতায়াত করি। এর আগে কৃষকদের জমির আইল ছিল চলাচলের রাস্তা। অসুস্থ রোগীকে জানাজার খাটিয়া দিয়ে চিকিৎসার জন্য নিতে হয়েছে।'
নয়াচর গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি নায়েব আলী জানান, একটা সময় ছিল এ গ্রামের মানুষের শিক্ষা গ্রহণ করা ছিল বিলাসিতা। আজ থেকে ত্রিশ' বছর আগে এ গ্রামে কোনো শিক্ষিত লোক ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাগালের মধ্যে না থাকায় শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে নয়াচর গ্রাম। নারীদের নিরাপত্তা ও দূরে স্কুল হওয়ায় এই গ্রামে নারী শিক্ষা একেবারে নাই বললেই চলে।
সত্তোর্ধ নারী আয়েশা বেগম বলেন, '৪০-৪৫ বছর হবে এ গ্রামে এসেছি। শুধু মাত্র একবার এমপি নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। রাস্তাঘাট না থাকায়; ভোট কেন্দ্র আরেক গ্রামে হওয়ায় আর ভোট দিতে যাইনি।'
নয়াচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক সাম্মি আক্তার বলেন, বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ১৩৩ জন শিক্ষার্থী আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপের কারণে পঞ্চম শ্রেণির পর শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীদের আর লেখাপড়া হয় না। ফলে বাল্যবিয়ের হার গ্রামটিতে চোখে পড়ার মতো। শ্রেণিকক্ষের অভাবে একই কক্ষে একাধিক শ্রেণির কাজ করতে হচ্ছে।
নয়াচর কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার আরিফ হোসেন বলেন, শিশু ও কিশোর বয়সের রোগীরা বেশি আসেন। যার মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। এলার্জি ও ঠান্ডাজনিত রোগে এ গ্রামের মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা লিপি আক্তার বলেন, নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে আনা হয়েছে।
নারান্দিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুজ্জামান খোকা বলেন, 'উপজেলা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর অনেকে জনপ্রতিনিধি হয়েছে। কেউ এ গ্রামের উন্নয়নে এগিয়ে আসেনি। আমি চেয়ারম্যান হওয়ার পর নয়াচর গ্রামের যাতায়াতের জন্য একাধিক রাস্তা আইডিভুক্ত করেছি। একটি সেতু নির্মাণে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে, গ্রামে বাল্যবিয়েরোধ, শিক্ষার হার বৃদ্ধিসহ জীবন মানের উন্নয়ন হবে।
ইউএনও সুমাইয়া মমিন বলেন, 'আমি সরেজমিন গ্রামটি পরিদর্শন করব। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে, কিভাবে গ্রামটিকে আধুনিকায়ন করা যায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।'