অর্থকরী ফসল হিসেবে বস্তায় আদা চাষে আশার আলো

প্রকাশ | ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
মেহেরপুর ও কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে বাণিজ্যিকভাবে বস্তা পদ্ধতিতে চাষ করা আদা -যাযাদি
অর্থকরী ফসল হিসেবে বস্তায় আদা চাষে আশার আলো দেখছেন চাষিরা। তাই দিন দিন বাড়ছে এ পদ্ধতিতে আদা চাষ। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত- মেহেরপুর প্রতিনিধি জানান, মেহেরপুরে বাণিজ্যিকভাবে বস্তা পদ্ধতিতে আদা চাষ বেড়েছে। গতবছর পরীক্ষামূলক এই পদ্ধতিতে আদা চাষ করে সফল হয়েছেন অনেক চাষি। তাই এবার অনেকেই বস্তায় আদা চাষ করেছেন। কৃষি প্রযুক্তির এই আধুনিকায়নে কৃষকের পরিত্যক্ত জায়গা ব্যবহারে এই পদ্ধতিতে আদা চাষ করতে এবার ব্যাপক সাড়া পড়েছে চাষিদের মধ্যে। ফলে অর্থকরী ফসল হিসেবে বস্তায় আদা চাষে আশার আলো দেখছেন চাষি। প্রতি ইঞ্চি জায়গা চাষের আওতায় আনতে কৃষি অফিসের উদ্যোগে প্রদর্শনী পস্নটের মাধ্যমে পরিত্যক্ত জমিতে গতবছর পরীক্ষামূলক বস্তা পদ্ধতিতে জেলার ২০ জন চাষি প্রায় ছয় হাজার বস্তায় আদা চাষ করেছিলেন। প্রথম বছরই সফলতা পাওয়ায় এবার চাষিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। যার কারণে এবার জেলায় আদা চাষ হয়েছে ২৫ হাজার বস্তায়। প্রথমে একটি বস্তায় তিন ঝুড়ি মাটি, এক ঝুড়ি বালি, এক ঝুড়ি গোবর সার ও ২৫ গ্রাম দানাদার কীটনাশক মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে বস্তায় ভরে ১২০ গ্রাম অঙ্কুরিত আদা পুঁতে এই চাষ করা হয়। প্রতি বস্তা আদা চাষে খরচ সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। ইতোমধ্যে আদার গুটি নিয়েছে। তাদের আশা গতবারের তুলনায় এবার ভালো ফলন হবে। সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের আদা চাষি খলিল জানান, গতবার তিনি প্রদর্শনী পস্নটে সাড়ে ৩০০ বস্তায় আদা চাষ করেছিলেন। প্রতি বস্তায় ৮০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত আদার ফলন পান। বাজারে ২০০ টাকা কেজি দরে প্রায় ৫০ হাজার টাকার আদা বিক্রি করেন। সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের আদা চাষি কুতুব উদ্দীন জানান, গতবার বস্তা প্রতি ৪০ গ্রাম করে আদার বীজ লাগানো হয়েছিল। এবার বস্তা প্রতি ১২০ গ্রাম করে বীজ লাগানো হয়েছে। ফলে এবার ফলন বেশি হবে। প্রতি বস্তায় যদি দুই কেজি করেও ফলন পাওয়া যায় সেখানে বাজারে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও বস্তা প্রতি ৪০০ টাকার আদা বিক্রি হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার জানান, বস্তায় আদা চাষ করতে ভালো জমি লাগে না। ছায়াযুক্ত পরিত্যক্ত জায়গা, জমির আইল বা বাগানের মধ্যে এই চাষ করা যায়। চাষিরা যাতে তাদের জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারে সে জন্য পরিত্যক্ত জায়গায় বস্তায় আদা চাষে সার্বিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে ব্যাপকহারে বেড়েছে বাণিজ্যিকভাবে বস্তায় আদা চাষ। বাড়ির আনাচে-কানাচে, সুপারি বাগান, কলা বাগান, বাড়ির ছাদ, অনাবাদি ও পতিত জমিসহ বিভিন্ন জায়গায় বস্তায় মাটি ভরাট করে কিংবা টবে আদা চাষে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের। কৃষকরা বলছেন সেচ, কীটনাশক ও সার প্রয়োগসহ বস্তা প্রতি উৎপাদন ব্যয় হয়েছে ৪০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। অল্প পরিচর্যা আর উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় আদা চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন তারা। এছাড়াও বিয়ে, জন্মদিন, কুলখানি, আকিকাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তরকারি ও খাবারের স্বাদ বাড়াতে মশলা জাতীয় এই আদার ব্যবহার করে থাকেন রাঁধুনিরা। এমনকি বিভিন্ন রোগে ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয় এটি। তাই বাজারে আদার চাহিদাও অনেক বেশি। ফলে আদা চাষে উৎসাহ বাড়ছে। বেকারদের কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব আদা যাবে দেশের বিভিন্ন জেলায়। গাগলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খাইরুল আলম জানান, গত বছর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং ইউটিউবে আদা চাষের সাফল্য দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ বছর নিজেই সুপারি বাগানের ভেতর ৯০০ বস্তায় আদা চাষ করেছেন। ফলন ভালো হয়েছে। কৃষক বেলাল হোসেন জানান, তিনিও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও ইউটিউবে দেখে তার বন্ধু শফিকুল মিলে এ বছর নাগেশ্বরী ব্যাক মোড় সংলগ্ন জায়গায় প্রাথমিকভাবে তিন হাজার বস্তায় আদা চাষ করেছেন। ফলন ভালো হয়েছে, তাই ভালো লাভের আশা তাদের। পরের বছর আরও বেশি করে আদা চাষের পরিকল্পনাও রয়েছে এই দুই বন্ধুর। রায়গঞ্জ ইউনিয়নের বড়বাড়ী এলাকার আজিবর রহমান বেসরকারি সংস্থায় করা চাকরি ছেড়ে বাড়িতে ফিরে বেকার হয়ে যান। পরে বাড়ির পাশে সুপারি বাগানের পাশে ৭৫০ বস্তায় আদা চাষ করেছেন তিনি। এতে বস্তা ক্রয়, মাটি ভরাট, সার প্রয়োগসহ সবমিলে তার খরচ হয়েছে বস্তা প্রতি ৪০ টাকা। এ বছর প্রতি বস্তায় ১ থেকে ২ কেজি পর্যন্ত আদা পাবেন বলে প্রত্যাশা তার। উপজেলা কৃষি অফিসার শাহরিয়ার হোসেন বলেন, এ বছর উপজেলায় ব্যপকহারে বস্তায় আদার চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে প্রায় ৩০ হাজার বস্তায় আদার চাষ হয়েছে। অল্প খরচ আর অল্প পরিচর্যার মাধ্যমে আদার ফলন ভালো হওয়ায় দিন দিন এ মসলা জাতীয় ফসল চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। কৃষি বিভাগের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক মাঠপর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। পার্বতীপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বস্তায় আদা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকরা। বস্তায় আদা চাষে বাড়তি জমির প্রয়োজন হয় না এবং অন্য ফসলের উপরে কোনো প্রভাব পড়ে না। তাছাড়া ভালো ফলনও পাওয়া যায়। যে কারণে বস্তায় আদা চাষে কৃষকেরা আগ্রহী হচ্ছেন। জানা গেছে, বস্তায় আদা চাষ আধুনিক কৃষির গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এ পদ্ধতিতে আদা চাষ করলে বাড়তি জমির প্রয়োজন হয় না। ফলে অন্য ফসল আবাদের উপর কোনো ধরনের প্রভাব পড়ে না। বিভিন্ন ফল বাগান, বসতবাড়ির আশপাশে ছায়াযুক্ত জায়গা এমনকি বাড়ির ছাদে বস্তায় আদা চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। একই জমিতে ফলবাগান ও বস্তায় আদা চাষ করা হলে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পায়। উপজেলা কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ ও সহযোগিতায় পার্বতীপুরে চলতি বছর বস্তায় আদা চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনে বস্তায় আদার অবস্থা এবং কৃষকদের উচ্ছ্বাস জানান দিচ্ছে ভালো ফলনের। উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের কৃষক আমিনুল ইসলাম বাচ্চু চলতি বছর ৫ হাজার বস্তায় আদা চাষ করেছেন। সার্বিক পর্যালোচনায় সামনের বছর তিনি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার বস্তায় আদা চাষ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পার্বতীপুর উপজেলা কৃষি অফিসার রাজিব হুসাইন উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বস্তায় আদা চাষের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।