সাঁওতালদের ব্যবহার করে জমি দখলের মহোৎসব

প্রকাশ | ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

দিনাজপুর প্রতিনিধি
দিনাজপুরের বিরলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (সাঁওতাল) পরিবারকে ব্যবহার করে জমি দখলের মহোৎসব চলছে। এক সময় আওয়ামী লীগের নেতা জমি দখল করে সেখানে সাঁওতাল পরিবার বসিয়ে রাখেন। আওয়ামী সরকার পতনের পর সেই দখল করা জমি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন আবার বিএনপি নেতারা। হাতিয়ার একটাই সাঁওতাল পরিবারকে ব্যবহার করে জমি দখল করা। একবার আওয়ামী লীগ অন্যবার বিএনপি এভাবেই মিলেমিশেই চলছে জমি দখল। জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দিনাজপুর-২ (বিরল-বোচাগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সমর্থনে বিরল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ইসহাক আলীর নির্দেশনায়, উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম, ধামইর ইউপি চেয়ারম্যান মোসলেম উদ্দিন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মুসলেম উদ্দিন, চেয়ারম্যানের ভাই বাবু ও সাঁওতাল নেতা আব্দুল কুদ্দুসের মদদে ২০১৩ সালে বিরল উপজেলার ধামইর ইউনিয়নের পিপলস্না গ্রামের পিপলস্না মৌজার ১ একর ৩০ শতক দখল করে। সেই জমিতে ১২-১৪টি সাঁওতাল পরিবারকে বসবাস করার জায়গা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা নিজেদের স্বার্থে দখল করে সাঁওতাল পরিবারদের সংখ্যা বাড়াতে থাকেন। যেহেতু সাঁওতাল পরিবার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও তাদের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে, তাই তাদের ব্যবহার করেই এ জমি দখলে নেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ধীরে ধীরে দখলকৃত জায়গায় সাঁওতাল পরিবারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। স্থানীয় ইউপি নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে সাঁওতাল ভোটাদের সংখ্যাও বেড়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা গা-ঢাকা দেন। তবে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা দখলকৃত জায়গা তাদেরই চাচাতো ভাই বিএনপির নেতা হায়দার আলী ও সাবেক সেনা সদস্য রেজাউল করিম এবং লাইসুর রহমান নিয়ন্ত্রণে নেন। এখন তারা সাঁওতাল পরিবারদের ব্যবহার করে ভূমি দখলের কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। বিএনপির এই নেতারা এখন সাঁওতালদের কাছে প্রতিদিন মদ, বাংলা চুয়ানি বিক্রির একটি কমিশন গ্রহণ করছেন। বিরলের পিপলস্না গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৫ আগস্টের পর কয়েকটি সাঁওতাল পরিবার ঘরবাড়ি ভেঙে অন্যত্র চলে যায়। পরে স্থানীয় বিএনপির নামধারী সাবেক সেনা সদস্য রেজাউল করিমের নির্দেশনায় সাঁওতাল পরিবারগুলোকে আবার সেই দখলকৃত জমিতে ফিরিয়ে আনা হয়। তাদের দিয়ে ভূমি দখল ও বাংলা মদ, চুয়ানির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বিএনপি নেতারা। ২০১৩ সালে দিনাজপুর যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মোতাহার আলী, মোখলেছুর রহমান, নজরুল ইসলাম, বেলাল হোসেনসহ ৯ জন বাদী হয়ে ৪৮ জন সাঁওতালের নাম উলেস্নখ করে উচ্ছেদ মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি চলমান রয়েছে। জমির রেকর্ড সূত্রে জমির উত্তরাধিকারী নজরুল ইসলাম বলেন, 'এ জমি আমাদের পূর্বপুরুষের। তখন থেকেই ধারাবাহিকভাবে পিপলস্না মৌজার জমি ভোগ দখল করে আসি। হঠাৎ করেই ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের সেই সময়ের প্রভাবশালী সাংসদ খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর দিকনির্দেশনায় বিরল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইসাহাক আলি আমাদের জমি জোরপূর্বক দখল করে সাঁওতাল পরিবারকে বসিয়ে দেয়। তখন থেকেই আদালতে মামলা চলছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মামলার শুনানি হবে বলে আশা করছি।' মোখলেছার রহমান জানান, 'এ মৌজার ১৩০ শতক জমি আমার পূর্বপুরুষের এসএ রেকর্ড ও সিএস রেকর্ডসহ বিএস রেকর্ড আমাদের নামে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের স্থানীয় নেতাদের যোগসাজশে আমাদের এই রেকর্ডীয় সম্প্র্রতি দখল করে নেয়। সাঁওতাল পরিবারদের ব্যবহার করেই জমি দখলে নেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মীয়-স্বজন বিএনপি নেতারা দখলে রেখেছেন।' তবে পিপলস্না গ্রামের বিন্দু গুঞ্জার বলেন, '২০ বছর ধরে এ জায়গায় আমরা রয়েছি। আমাদের নিজস্ব কোনো জমি জায়গা নেই। তাই এখানে দেবোত্তর জায়গা আছে বলে আমরা জানতে পারি। সেজন্যই আমরা এখানে বসবাস করছি।' ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী লগেন গুঞ্জার বলেন, 'এ জায়গাটি আমাদের নয়। আমাদের এখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ আমাদের নিজস্ব কোনো জায়গা জমি নেই। তাই এখানে বসবাস করছি।' অজয় গুঞ্জার নামে আরেকজন বলেন, 'আগে আমরা অন্য জায়গায় ছিলাম। কিছুদিন আগেই এখানে এসেছি। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর আমরা কয়েকটি পরিবার চলে গিয়েছিলাম। পরবর্তীতে আবার এখানে নতুনভাবে ঘর তৈরি করেছি। একটি এনজিও আমাদের আর্থিক সহযোগিতা করেছে।' রবি গুঞ্জার বলেন, 'এ জমি নিয়ে আদালতে মামলা আছে। জমিটি হচ্ছে দেবোত্তরের। তাই আমরা এখানে আছি। আমাদের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। এখানে ১৩-১৪ পরিবার বসবাস করছি। বেশিরভাগই সাঁওতাল পরিবার।' ইউপি চেয়ারম্যান মোসলিম উদ্দিন বলেন, সাঁওতাল পরিবারগুলো একেবারেই নিরীহ। তাদের বসবাসের জমি নেই। দেবোত্তরের জায়গা মনে করে তাদের বসবাস করতে দেওয়া হয়েছে মাত্র। সাঁওতাল পরিবারগুলো নিজস্ব ধর্মীয় মতেই নিজেদের জন্য মদ বা তারি তৈরি করে।' দিনাজপুর সহকারী কমিশনার ভূমি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, 'বিরলের পিপলস্নার মৌজার যে জমির বিরোধ রয়েছে, তার মাত্র ৯ শতক জমি দেবোত্তরের নামে রেকর্ড আছে। অভিযোগ পাওয়ার পর সাঁওতাল পরিবারগুলোর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। তাদের ব্যক্তি মালিকানা জমি ছেড়ে দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। সরকারিভাবে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কেন জানি সেখান থেকে যেতে চাচ্ছে না।'