গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি এখন শুধুই গল্প

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

এটিএম সালাম, নবীগঞ্জ ( হবিগঞ্জ)
ও বউ ধান ভানে রে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া ও বউ ধান ভানে রে...। এই গানের মধ্যে গ্রাম-বাংলায় ধান ভানার ঐতিহ্যবাহী অনুষঙ্গ ঢেঁকির সঙ্গে গ্রামীণ নারীর মিশে থাকার গভীরতা কিছুটা হলেও ফুটে উঠেছে। গম, চিড়া, হলুদ, মরিচ গুঁড়া করতে প্রাচীনকাল থেকেই ঢেঁকির ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে আধুনিক যন্ত্রের আগমনে গ্রাম-বাংলার এই ঐতিহ্য প্রায় বিলুপ্তির পথে। বেশির ভাগ এলাকায় ঢেঁকি দেখা যায় না বলে নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটা গল্পের উপাদান হয়ে গেছে। ঢেঁকি মূলত পা-চালিত সরঞ্জাম। লম্বা একটি গাছকে মোটামুটি ১২ থেকে ১৫ ফুট লম্বা করে কেটে ঢেঁকি বানানো হয়। মাঝখানে ছিদ্র করে আরেকটি গোলাকার কাঠ ঢুকিয়ে দুপাশে দুই খাড়া কাঠে আটকে দেওয়া হয়। এর একপাশে পা দিয়ে চাপ দিতে হয়। অন্যপাশে একটি খুঁটির মতো অংশ থাকে। এই খুঁটি গর্তে থাকা শস্যদানার খোসা ছাড়ানো ও গুঁড়া করার কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রবীণেরা বলছেন, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার গ্রামাঞ্চলের মানুষ ধান ভানার জন্য একসময় ঢেঁকির ওপর নির্ভরশীল ছিল। তখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ঢেঁকি ছিল। ঢেঁকির জন্য থাকত আলাদা ঢেঁকিঘর। গ্রামের বধূরা ভোররাত থেকেই ধান ভানা শুরু করত। ঢেঁকির ঢাঁকুর-ঢেঁকুর শব্দে বাড়ির অন্য সবার ঘুম ভানত। নারীরা ঢেঁকিতে পাড় দিত আর ধান ভানত। ঢেঁকিতে কে কত পাড় দিতে পারে, সেই প্রতিযোগিতাও চলত। গ্রামীণ বধূদের আলতারাঙা পায়ের স্পর্শে ঢেঁকিও যেন নেচে-গেয়ে উঠত! প্রতিবছর নবান্ন উৎসবে গ্রামগুলোতে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল গুঁড়া করা উৎসবে রূপ নিত। ঢেঁকিতে ভানা আটা দিয়ে ভাপা, পাটিসাপটাসহ নানা ধরনের পিঠা-পুলি তৈরি করা হতো। তবে, নবীগঞ্জ উপজেলার প্রায় গ্রামে এখনো কিছু ঢেঁকির দেখা মিললেও এর ব্যবহার কমে গেছে। মানুষ এখন কষ্ট করে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান, গম ভানে না। ঢেঁকির বদলে রাইস মিল থেকে ভানিয়ে নিয়ে আসে। তবে এখনো কিছু মানুষ আছে, যারা ঢেঁকিতে গম ভানিয়ে আটা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ঢেঁকিতে ছাঁটাই করা চালের ভাত খেতে খুব সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর হলেও ঢেঁকির ব্যবহার কমে যাওয়ায় মানুষ এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানে না। নবীগঞ্জ সরকারি জেকে হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক (অব.) আব্দুস সালাম বলেন, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকির আর তেমন দেখা মেলে না। তবে তাঁদের বাড়িতে এখনো একটি ঢেঁকি আছে। গৃহস্থসহ পাড়া-প্রতিবেশীরা পিঠা তৈরির জন্য সিদ্ধ চাল এই ঢেঁকিতে ভানিয়ে নিয়ে যান। এক গৃহবধূ ফুলেতা বেগম বলেন, এখন আর কেউই ঢেঁকি দিয়ে ভাতের চাল ভানে না। শুধু পিঠা তৈরির জন্য সিদ্ধ চাল গুড়াঁ হয় ঢেঁকিতে।