পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটানো, সুখে শান্তিতে বসবাসের জন্য বুকভরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে লিবিয়া হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাবে মাদারীপুর সদর উপজেলার পাচখোলা ইউনিয়নের পশ্চিম পাচখোলা গ্রামের ওমর আলী সরদার ও হনুফা বেগমের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন স্বপন (৪০)। কিন্তু সে স্বপ্ন এখন বড় দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। লিবিয়াতে দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে, শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার ও জেলে বন্দি থেকে পঙ্গু হয়ে অসুস্থ অবস্থায় ১৫ মাস পরে দেশে ফিরে আসেন স্বপন। এখন নিজের জীবন বাঁচাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বপনের। লাখ লাখ টাকা দালালদের হাতে দিয়ে এখন নিঃস্ব্ব হয়ে গেছেন। অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না। চেয়েছেন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা।
জানা যায়, স্বপনের সংসারে দুই সন্তান, স্ত্রী ও বাবা রয়েছে। বড় মেয়ে মোহনা আক্তার (১৩) স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে সাঈদ (১০) স্থানীয় মাদ্রাসায় হাফেজী লাইনে পড়াশোনা করছে। স্বপনের বাবা ওমর আলী সরদার চোখে কম দেখা ও অসুস্থতার জন্য কোনো কাজ করতে পারেন না। স্বপনের টাকায় পুরো সংসার চলত। প্রথমে তিনি মোটর সাইকেল ভাড়ায় যাত্রী আনা-নেওয়া করতেন। পরে একটি ইটভাটায় কাজ করতেন। সংসার তাদের মোটামুটি ভালোই চলছিল। মাদারীপুর সদর উপজেলার তাতীবাড়ি এলাকার রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী দালাল সোহাগ হোসেন ও একই উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের দালাল দেলোয়ার সরদারের সঙ্গে পরিচয় হবার পর স্বপনকে ইতালি যাবার জন্য লোভ দেখান। তাদের ফাঁদে পড়ে দালাল দু'জনের সঙ্গে ১২ লাখ টাকায় চুক্তি করেন। প্রথমে দালাল সোহাগের কাছে ১২ লাখ ও পরে আরেক দালাল দোলোয়ার সরদারের সঙ্গে ৩ লাখ টাকা দেন।
এরপর প্রায় ১৫ মাস আগে স্বপ্নের দেশ ইতালি যাবার জন্য বাড়ি থেকে বের হন স্বপন। এরপর দুবাইতে দালালদের একটি ক্যাম্পে ৫ দিন থাকেন। পরে লিবিয়াতে তাকে আনা হয়। সেখানে আনার পর শুরু হয় অত্যাচার। প্রায় তিন মাস চলে অত্যাচার, পুলিশে ধাওয়া ও পরে জেলহাজতে যেতে হয়। ২৮ দিন লিবিয়াতে জেলহাজতে থাকতে হয়েছে স্বপনকে। এরপর ইতালি যাবে এমন বিভিন্ন দেশের ১২৮ জনকে একটি ভবনে রাখা হয়। একরাতে পুলিশ ঐ ভবনে রেড দেন। এ সময় অনেকেই ভয়ে দোতালার ছাদ থেকে লাফ দেন। স্বপনও পুলিশের হাতে ধরার পরার ভয়ে লাফ দেন। সেই লাফই তার জীবনের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। নিচে পড়ে যাবার পর আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি তিনি। স্থানীয় একজনের সহযোগিতায় হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর দালাল সোহাগ ও দেলোয়ার আর কোনো খোঁজ রাখেনি স্বপনের। স্বপন একটু সুস্থ হলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব জানান। তখন তার স্ত্রী দালালদের কাছে গেলে, স্বপনের ব্যাপারে দ্রম্নত ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান। কিন্তু এরপর দালালরা আর কোনো খোঁজ নেননি স্বপনের।
পারিবারিক সূত্রে আরও জানা যায়, কোনো উপায় না পেয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আরেক দালালের সন্ধান পান স্বপনের স্ত্রী মিনু বেগম। মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়ের পখিরা গ্রামের দালাল সাগর মলিস্নকের সঙ্গে স্বপনের স্ত্রী মিনু বেগমের কথা হয়। ঐ দালাল জানান, স্বপনকে দ্রম্নত দেশে আনার ব্যবস্থা করা হবে। তার জন্য ১০ লাখ টাকা চুক্তি হয়। ধার-দেনা, লোন ও মিনুর তার বাবার বাড়ির জমি বিক্রি করে টাকা যোগাড় করেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। অসুস্থ অবস্থায় কোনো রকম ওষুধ ছাড়াই স্বপনকে ফেলে রাখা হয় একটি ঘরের টয়লেটের পাশে ছোট একটি জায়গায়। কোনো দিন খেতে দিত, আবার দিত না। মেরুদন্ড ও হাত-পা ভেঙ্গে যাওয়ার প্রচন্ড ব্যথায় চিৎকার করলেও তাকে একটি ওষুধ দেওয়া হতো না। এভাবে দীর্ঘ ছয় মাস পার হয়। এরপর তাকে অক্টোবরের ১১ তারিখে দেশে আনা হয়। এয়ারপোর্ট থেকেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে তাকে মাদারীপুরের নিজ বাড়িতে আনা হয়। টাকার অভাবে তার উন্নত চিকিৎসা করাও সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া তিনি হাটা তো দূরের কথা ওঠে বসতেও পারেন না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। একমাত্র উপার্জন সক্ষম ব্যক্তির এই করুণ অবস্থা হওয়ায় পুরো পরিবার ভেঙ্গে পড়েছে। তারা খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমভাবে জীবনযাপন করছেন। আগামীতে তাদের কীভাবে দিন যাবে, তা তারা জানে না। স্বপ্নের দেশ ইতালিতে অবৈধভাবে যাবার পথে আজ তারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। শুধু থাকার জন্য বাড়িটি ছাড়া আজ তাদের কিছুই নেই। উল্টো ধার-দেনা আর কিস্তির টাকার জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েছে পরিবারটি।
এ ব্যাপারে তার স্ত্রী মিনু বেগম বলেন, দালাল সোহাগ ও দেলোয়ার তারা কেউ আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করছে না। টাকা ফেরত চাইলে তাও দিচ্ছে না। আরেক দালাল সাগর মলিস্নকে ১০ লাখ টাকা দেই। সাগরের দুলাভাই আশরাফ দুবাই থাকেন। আর আশরাফের ভাই বাহার লিবিয়াতে থাকেন। তাদের মাধ্যমে অসুস্থ স্বপনকে দেশে আনার কথা হয়। কিন্তু তারা দীর্ঘ ছয় মাস ঘুরিয়ে তবেই স্বপনকে দেশে এনেছে। আমার স্বামী এখন বিছানা থেকে উঠতে পারে না। হাটতে পারে না। মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু টাকার জন্য কিছুই করতে পারছি না।
এখন তার চিকিৎসা তো দূরের কথা ঠিকমতো খেতেই পারি না। আর এই দুই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা কীভাবে করাব। আমাদের পুরো সংসার আজ শেষ হয়ে গেল। আমি দালালদের বিচার চাই। আর সবার সহযোগিতা চাই। যাতে করে স্বপনকে একটু চিকিৎসা করাতে পারি।
অসুস্থ স্বপনের মেয়ে মোহনা আক্তার বলেন, আমরা বাবাকে এভাবে আমরা দেখতে পারছি না। অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমরা দালালদের বিচার চাই।
এ ব্যাপারে দালাল সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনে বলেন, স্বপনের পরিবার আমার কাছে কোনো টাকাপয়সা দেয়নি। টাকা দিয়েছে দেলোয়ার সরদারের কাছে। দেলোয়ার সরদারকে জিজ্ঞেস করেন, তিনিই সব জানেন।
দালাল দেলোয়ার সরদারের মোবাইল ফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। তাই তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মাদারীপুরের সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আফজাল হোসাইন বলেন, তারা যদি সহযোগিতার জন্য দরখাস্ত দেন, তাহলে তাদের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করা হবে। তাছাড়া থেরাপী দিতে চাইলে, সরকারিভাবে বিনা টাকায় সমাজসেবা থেকে দিতে পারবেন। আর প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য দরখাস্ত করলে, তাও করে দেওয়া যাবে।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। তিনি যদি চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা চান, তাহলে তার চিকিৎসার জন্য সমাজসেবা থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।