ঝিনাইদহ শিশু হাসপাতাল, চারঘাট ও লাখাই স্বাস্থ্যকেন্দ্র

চিকিৎসক অক্সিজেন ও ওষুধ সংকটে ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা, রোগীদের চরম দুর্ভোগ

প্রকাশ | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

ঝিনাইদহ, চারঘাট (রাজশাহী), লাখাই (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি
উদ্বোধনের পর থেকেই নানা সমস্যার মধ্যে শিশুদের সেবা দিয়ে চলেছে ঝিনাইদহ ২৫ শয্যা সরকারি শিশু হাসপাতালটি। অর্থের অভাবে হাসপাতাল চত্বরে আবাদ করা কলা বিক্রির টাকা ও অনুদানের চলে চিকিৎসা সেবা। সরকারী উলেস্নখযোগ্য কোন বরাদ্দ না থাকায় চিকিৎসা সেবায় প্রয়োজনীয় যে কোন জিনিস কিনতে হয় অনুদানের টাকায়। এদিকে চিকিৎসক ও জনগণ জনবল সংকটে ধুকে ধুকে চলছে রাজশাহীর চারঘাট এবং হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স। এর ফলে স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন উপজেলাবাসী। এদিকে, জনবল সংকটের কারণে লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সটিতে চালু হয়নি ৫০শয্যার সেবা কার্যক্রম। ভুক্তভোগীরা দ্রম্নত জনবল নিয়োগ দিয়ে সমস্যা সমাধানের জোর দাবি জানিয়েছেন। ঝিনাইদহের ২৫ শয্যার সরকারি এ শিশু হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে রোগী থাকে ৬০ জনের বেশি চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ আছে পাঁচটি। চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন তিনজন। ফার্মাসিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওগ্রাফি), প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক, অফিস সহকারী কাম ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও স্টোরকিপারের পদ খালি। এছাড়া ২১ নার্স পদের বিপরীতে আছেন ১৭ জন। এমএলএসএস, ওয়ার্ড বয়, আয়া, মালি, নিরাপত্তাপ্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কোন পদই নেই। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির এ পদগুলো না থাকলেও নিয়োগকৃতদের বেতন হয় অনুদানের টাকায়। যশোরের কিছু ব্যবসায়ী, কয়েকজন চিকিৎসক এবং আলী হাসান ফরিদের একাধিক বন্ধুর সহয়তায় শয্যা, যন্ত্রপাতি ও জনবল দিয়ে সহায়তা করছেন। ঝিনাইদহ পৌরসভা এবং জাহেদি ফাউন্ডেশন নিয়মিত সহায়তা করে। এ ছাড়া ১৫ জন হৃদয়বান ব্যক্তি কিছু সহায়তা দেন। এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদরে অক্সিজেন ও ওষুধের যে চাহিদা তার অর্ধেকও বরাদ্দ নেই সরকারের। ২০০৫ সালের ৭ মে ঝিনাইদহ জেলা শহরের টার্মিনাল এলাকায় ২৫ শয্যা বিশিষ্ট বাংলাদেশের প্রথম সরকারি এ শিশু হাসপাতালেরর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। রাজনৈতিক বেড়াজালে আটকে বছরের পর পর বন্ধ থাকে হাসপাতালটি। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে হাসপাতালটি তার সেবা কার্যক্রম শুরু করে। হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উদ্বোধনের পর হাসপাতালে কোনো সরঞ্জাম না থাকায় কনসালট্যান্ট আলী হাসান ফরিদ তার বাসা থেকে ব্যক্তিগত কম্পিউটারে নিয়ে আসেন। ওই কম্পিউটার হাসপাতালের কাজে ব্যবহার করেন এবং শিশুদের চিকিৎসা ও মায়েদের পরামর্শ দেন। এভাবে আস্তে আস্তে হাসপাতালটি আশপাশের এলাকার মানুষের কাছে সুনাম অর্জন করেছে। মানুষ এখন এ হাসপাতালের চিকিৎসাসেবাই আস্থাও রাখেন। কিন্তু সিভিল সার্জন কার্যালয় বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতালটির ওপর কোন নজর নেই। যে কারনে হাসপাতালের কর্মকর্তারা বারবার অনুরোধ করেও জনবল, যন্ত্রপাতি ও অর্থসহায়তা পান না। সরেজমিন শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, প্রথমে বড় একটি প্রবেশ গেট। ভিতরে প্রবেশ করলে চারিপাশে নানা ধরণের ফুলের বাগান। এর সামনে লাল ইটের দোতলা ভবন। হাসপাতাল চত্বরটি খুবই পরিপাটি করে সাজানো। ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, পর্যাপ্ত শয্যা আছে। শয্যাগুলোর গায়ে লেখা, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সেগুলো দান করেছেন। কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা একজন নারী বললেন, 'আমার ১৮ মাসের শিশুর শ্বাসকষ্ট হলে প্রথম উপজেলা হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এখানে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়। এখানে এসে সন্তান বর্তান অনেকটা ভালো আছে।' হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগ ও স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন পর চালু হলেও নানা সংকট রয়েছে হাসপাতালটিতে। দেশের একমাত্র সরকারি শিশু হাসপাতাল হওয়া স্বত্বেও নেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কোনো ল্যাব। যে কারণে হাসপাতালে ভর্তি থাকার পরও বাড়তি টাকা খরচ করে বাইরে থেকে পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এতে ভোগান্তির পাশাপাশি বাড়তি টাকা খরচ হচ্ছে। কনসালট্যান্ট আলী হাসান ফরিদ বলেন, হাসপাতালে নানা সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের জন্য বছরজুড়ে কৃত্রিম অক্সিজেনের দরকার হয়। এতে বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার অক্সিজেন লাগে। সরকারের কাছ থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা পাওয়া যায়। হাসপাতালের পড়ে থাকা তিন বিঘার মতো জমিতে কলা চাষ করা হয়। কলা বিক্রি করে গত বছর আশি হাজার টাকার অক্সিজেন কিনেছেন। এ বছরও তাুই করতে হবে। এছাড়া হাসপাতালে রাতের নিরাপত্তার জন্য লাইট ও অন্যান্য জিনিসপত্র কলা বিক্রির টাকা দিয়েই কিনতে হয়। এছাড়া ওষুধ, অক্সিজেন এ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন ভাতা দিতে হয় অনুদানের টাকায়। জনবল ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য সিভিল সার্জন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখায় অনেকবার আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি বলছিলেন, কনসালট্যান্ট আলী হাসান ফরিদ। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সটিতে চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। প্রায় ৩ লাখ জনবসতির চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসাস্থল এ হাসপাতাল। তবে হাসপাতলটিতে রয়েছে চিকিৎসক সংকট। রয়েছে বিভিন্ন পদের কর্মচারী ও টেকনিশিয়ান সংকট। এতে চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন উপজেলার সাধারণ জনগন বিশেষ করে দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। চিকিৎসা সেবার মান নিশ্চিতে মনিটরিং জোরদার ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানান চারঘাট প্রেস ক্লাবের সভাপতি নজরুল ইসলাম বাচ্চু। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালে অনুমোদিত চিকিৎকের পদ ৩১টি। তবে খালি রয়েছে ২৪ পদ। ক্লিনার ৫ জনের স্থলে রয়েছে একজন এবং আয়া ২টি পদ খালি রয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে কার্ডিওলোজি, অর্থপেডিক্‌স, সার্জারি, ইএনটি, অপথোমেলোজি ও সাজারি বিভাগে চিকিৎসক নেই। টেকনেশিয়ান ও অপারেটরের অভাবে পড়ে আছে এক্‌্ররে, ইসিজি ও সনোরোজিস্ট মেশিন। বদলী, প্রশাসনিক কাজ, ডেপুটেশন ও উচ্চোতর শিক্ষা ছুটিতে থাকায় হাসপাতালে রোগীদের অন্যান্য সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্মরত ডাক্তার, নার্সদের। চিকিৎসা সেবায় এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চিকিৎসা নিতে আসার রোগীদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। চিকিৎসক সংকটে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও রোগীরা কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫শ' রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। মাত্র ৬ জন মেডিকেল অফিসার দিয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মেডিকেল অফিসার ডা. দিপ্ত কমার দাস। সহকারী ডেন্টাল সার্জন ডা. গিয়াস উদ্দীন জানান, প্রায় ৫ বছর ধরে এ হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। হাসপাতালে নামমাত্র ডেন্টাল ইউনিট রয়েছে। ডেন্টাল চিকিৎসার জন্য নু্যনতম প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম নেই। একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে চিকিৎসার সরঞ্জামের চাহিদা দিলেও না পেয়ে তিনি হতাশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে অভিযোগ করে বলেন, ডাক্তার সংকটে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থানীয় ক্লিনিকগুলোতে গিয়ে অতিরিক্ত ফি'র বিনিময়ে চিকিৎসা সেবা নিতে হয়। সরেজমিনে গিয়ে শনিবার দুপুর ১২টায় হাসপাতালের আউটডোরে কোনো চিকিৎসককে দেখা যায়নি। চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মিয়াপুর গ্রামের মায়েন উদ্দীন জানান, এ হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সেবার মান নাই বললেই চলে। এছাড়া দিনে কয়েকজন চিকিৎসকের দেখা মিললেও রাতে চিকিৎসকের দেখা মেলা ভার। হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শাওন কুমার দাস বলেন, হাসপাতালে কনসালটেন্টসহ চিকিৎসক সংকটে রয়েছে। এতে কিছুটা সমস্যাতো হচ্ছে। শতভাগ ইচ্ছে থাকলেও অতিরিক্ত চাপ ও দায়িত্ব নিয়ে চিকিৎসাসেবা দেয়া কঠিন। তবে স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের বিভিন্ন পদের ডাক্তার, টেকনিশিয়ান ও অপারেটরদের চাহিদা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই চিকিৎসক সংকটের সমস্যা সমাধান করা হবে বলে জানান চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তৌফিক রেজা। লাখাই (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার প্রায় ২লাখ মানুষের জন্য একমাত্র স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। সেই সঙ্গে ৫০ শয্যায় উন্নীত স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সটিতে জনবল সংকটের কারণে দাপ্তরিক কর্মকান্ডে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। মফস্বলের ৬টি ইউনিয়নের প্রায় দুই লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সেবার এক মাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানটিতে ৪জন কনসালটেন্টসহ ৯জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ৩ জন। ২০০০ সালে ৩১ শয্যার স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সটিকে সময়ের প্রয়োজনে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও অধ্যবদি স্বাস্থ্য সেবা চলছে ৩১ শয্যার আদলে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে কনসালটেন্ট সার্জারি-মেডিসিন-গাইনি- অ্যানেস্থিসিয়া-ডেন্টাল এবং আরএমও পদে শূন্যতা রয়েছে। সেই সঙ্গে মেডিসিন কনসালটেন্টে দায়িত্ব প্রাপ্ত অমিত কুমার রায় ২০১৩ সাল থেকে অনুপস্থিত রয়েছেন। এতে করে মফস্বলের এ জনপদের প্রসুতিসহ চিকিৎসা সেবা প্রার্থীদের পোহাতে হচ্ছে নানাবিদ দুর্ভোগ। অন্যদিকে চিকিৎসাসেবায় দায়িত্বরত বিভিন্ন দাপ্তরিক পদের লোকবলসহ স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের জনবল সংকট রয়েছে বিভিন্ন পদে একাধিক। ফলে একদিকে স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের ইসিজি, এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রামসহ চিকিৎসা সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিঘ্ন ঘটছে, অন্যদিকে স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স এলাকায় পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. কাজী শামসুল আরেফিন জানান, চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। চিকিৎসক পাওয়া গেলে আশা করছি সংকট থাকবে না।