দিনাজপুরে এক ফসলি জমিকে তিন ফসলিতে রূপান্তর

প্রকাশ | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

রেজাউল করিম রঞ্জু, দিনাজপুর
তিন দশক আগেও দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় অধিকাংশ অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে শুধু আমন ধানের চাষ হতো। বাকি সময় অনাবাদি পড়ে থাকত। সেই অনাবাদি প্রায় ২৬০ একর জমি এখন রূপ নিয়েছে তিন ফসলি জমিতে। চাষ হচ্ছে আমন-বোরো এবং আলুসহ অন্যান্য সবজি। কয়েক হেক্টর জমিতে গড়ে উঠেছে আম-লিচুর বাগান। সাতটি গভীর নলকূপের মাধ্যমে জমিগুলোতে সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে সেই জমিতে ভিত্তি বীজ থেকে উৎপাদিত হচ্ছে শত শত টন মানঘোষিত ধান ও আলু বীজ। এক ফসলি জমিকে তিন ফসলিতে রূপান্তর করে তাতে বীজ উৎপাদনকারী এই কৃষকের নাম মতিউর রহমান। উপজেলার পুরিয়া গ্রামের প্রয়াত স্কুলশিক্ষক কোবাদ আলীর ছেলে। দুই ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে মতিউর পঞ্চম। বাবার পাঁচ সন্তানই উচ্চ শিক্ষার গন্ডি পেরিয়েছেন। কিন্তু দাদার রেখে যাওয়া প্রায় ৩০ একর জমি চাষাবাদে খুব একটা আগ্রহ পায়নি পরবর্তী প্রজন্ম। ১৯৯৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াকালে কৃষির প্রতি মনোযোগ বাড়তে থাকে মতিউরের। বাবার অমতে ৭০টি লিচু গাছের বাগান করার মধ্য দিয়ে কৃষিতে পা রাখেন। তারপর ধীরে ধীরে সবজি চাষ, ধান চাষ, গরুর খামার, হাস্কিং মিল, মাছ চাষে যুক্ত হন মতিউর। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) দিনাজপুরের নিবন্ধিত কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার্স। দিনাজপুর বিএডিসিতে আমন, বোরো ও আলুর সর্বোচ্চ মানঘোষিত বীজ সরবরাহকারী। কৃষিতে সফলতার জন্য ২০০৮ সালে পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। দিনাজপুর বিএডিসি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দিনাজপুরে গত অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৫৬ হেক্টর জমিতে আমন আবাদে ৭ হাজার ৪৫৮ মেট্রিক টন বীজ, ১ লাখ ৭৪ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদে ৪ হাজার ৬৫৯ মেট্রিক টন বীজ এবং ৪৭ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে ৭৭ হাজার মেট্রিক টন আলু বীজ দরকার হয়। এর মধ্যে বিএডিসির কনট্রাক্ট গ্রোয়ার্স রয়েছেন ১৯০ জন। এসব কনট্রাক্ট গ্রোয়ার্সরা চাহিদার বিপরীতে ৭৮৭ মেট্রিক টন আমন বীজ, ৩ হাজার ৪২ মেট্রিক টন বোরো ধানের বীজ এবং ৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আলু বীজ সরবরাহ করেন। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি সরবরাহ করেন কৃষক মতিউর। চলতি অর্থবছরে বিএডিসিতে ৩৫ টন আমন ২২০ টন বোরো ও ১০০ টন আলু বীজ সরবরাহ করেছেন মতিউর। ১৯৯৮ সালে মতিউরের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তৎকালীন বিরল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার। ধান আবাদের কথা জানালে সেই কর্মকর্তা মাটি পরীক্ষা করার কথা জানান। সঙ্গে ধরিয়ে দেন ১০টি লিচুর গাছ। আর ৬০টি লিচু গাছের চারা কিনে মোট ৭০টি চারায় চকভবানীপুর এলাকায় রোপণ করেন। বাগানের ভেতরে লাগান বিভিন্ন জাতের সবজির চারা। এরইমধ্যে মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনে দেখেন জমিতে জৈব সারসহ বিভিন্ন উপাদানের ঘাটতি। গোবর সার, জৈব সারসহ নানাভাবে জমির যত্ন নেওয়া শুরু করেন। পরের বছর পুরিয়ায় একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করেন। সেচের মাধ্যমে শুরু হয় বোরো আবাদ। বিঘায় যেখানে ১০-১২ মণ ধান পেতেন সেবার পেলেন ২০ মণ। উন্নতজাত ও মানের হওয়ায় তার উৎপাদিত বীজ কেনে বিএডিসি। একইসঙ্গে তাকে আরও জমিতে বীজ উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দেয় বিএডিসি কর্তৃপক্ষ। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া জমিতেই আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদন বাড়াতে এবার জমির সন্ধানে বের হন মতিউর। পার্শ্ববর্তী দৈনাথপুর এলাকায় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে আলাপ করেন। ২০০৭ সালে ওই এলাকার মানুষের ৫০ একর জমি লিজ নেন। তিন বছর পর একইভাবে চকেরহাট এলাকায় মালডাঙ্গার পাথারে ১২০ একর, সত্যপীরের ডাঙ্গায় ৬০ একর অন্যের জমি লিজ নেন। তিন জায়গায় গভীর নলকূপ বসিয়ে শুরু করেন চাষাবাদ। শুরুতে প্রতি বিঘা মাটি ৫৫০০ থেকে ৬০০০ হাজার টাকায় চুক্তি নিলেও বর্তমানে বিঘা প্রতি পরিশোধ করতে হয় ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকা। তবে বর্তমানে অধিকাংশ কৃষক নিজেরাই আবাদ করছেন। কৃষক মতিউর তাদের জমি চাষ, চারা ও বীজ সরবরাহ, সেচের পানি এবং হারভেস্টর দিয়ে কাটামাড়াই করে দেন। এরজন্য বিঘা প্রতি মতিউর পান ২০-২২ হাজার টাকা। উৎপাদিত ফসল বাজারের দামেই মতিউরের কাছেই বিক্রি করতে পারেন কৃষকরা। তার এ কৃষি আবাদে সফলতার কারণে এলাকার জমির দাম বেড়েছে তিন থেকে দশ গুণ পর্যন্ত। বিশাল আয়তনের জমি চাষাবাদ করতে অনেক জৈবসারের প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ করে গোবর সারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ২০০৩ সালে বাড়ির পাশে ৪টি গরু দিয়ে খামার কার্যক্রম শুরু করেন। খামারে গো-খাদ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। মতিউর দেখেন বিএডিসিতে বীজ সরবরাহের ক্ষেত্রে বীজকে গ্রেডিং করার সময় প্রচুর পাতান বের হয়। সেই পাতান থেকে গো-খাদ্য প্রস্তুত করতে পরের বছর একটি হাস্কিং মিল স্থাপন করেন। নিজস্ব মিলে সেই পাতান থেকে খুদ ও কুড়া প্রস্তুত হয়। সেই খুদ ও কুড়ায় পুকুরে মাছ ও হাঁস, খামারে গরু খাবারের চাহিদা মেটে। আলাপচারিতার এক ফাঁকে ঘুরে ঘুরে তার প্রকল্পগুলো দেখান। বাড়ির পাশে পুকুর। পুকুরে দেশি-বিদেশি মাছের সঙ্গে হাঁসের খামার করা হয়েছে। পুকুরপাড়ে সজনা, সুপুরী, নারিকেল, খেজুর, পেঁপে, বারমাসী কাঁঠালসহ, বস্তায় আদা, রসুন, পেঁয়াজসহ অন্তত ৪০ রকমের গাছ ও সবজি চাষ করা হচ্ছে। মতিউর বলেন, তেল-লবণ-সাবান ছাড়া তেমন কিছু কিনতে হয় না। এই বিশাল কৃষি কর্মযজ্ঞে মতিউরের সঙ্গে আছেন ৫০-২৫০ জন কৃষি শ্রমিক। তবে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন তার কৃষি খামারে। আধুনিক কৃষির সঙ্গে মতিউরের সখ্যতা বেশ ঘনিষ্ঠ। কৃষিতে যখন যে ধরনের প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতি হয়েছেন, সেটিকেই গ্রহণ করার চেষ্টা করেছেন। জমি চাষ, চারা রোপণ, সার ছিটানো থেকে কাটা মাড়াই অধিকাংশ কাজেই প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছেন। পাওয়ার টিলার, চারা রোপণ যন্ত্র, হারভেস্টর, স্প্রে মেশিন প্রায় সব যন্ত্রই আছে তার কৃষি খামারে। কৃষিতে স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করতে ২০০১ সালে মতিউর এলাকায় গড়ে তুলেছেন পুড়িয়া মিলন সংঘ। তাতে স্থায়ী অস্থায়ী মিলে মোট সদস্য সংখ্যা ১৩৭ জন। ইতিমধ্যে একটি ঘরও তুলেছেন। এলাকার কৃষকদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সভা করেন। এলাকার কয়েকটি রাস্তায় গাছ লাগানো হয়েছে ৬ হাজার। কিছু গাছ বিক্রিও করা হয়েছে। বর্তমানে ৩ হাজার গাছ রয়েছে। প্রায় ২৮ বছর ধরে কৃষির সঙ্গে যুক্ত আছেন মতিউর। জানালেন, বর্তমানে কৃষি থেকে তার বাৎসরিক আয় প্রায় ৩৫-৪০ লাখ টাকা। এরমধ্যে করোনাকালে টমেটোতে লোকসান গুনেছিলেন। সরকারকে নিয়মিত করও পরিশোধ করে আসছেন। দুটি ট্রাক্টর কিনেছেন। শহরে জমি কিনেছেন। তিনটির জায়গায় এখন কৃষি এলাকায় ৭টি গভীর নলকূপ বসিয়েছেন। যার প্রতিটিতে খরচ হয়েছে ২৪ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। ব্যাংক থেকে কোটি টাকা ঋণও গ্রহণ করেছেন। কৃষক মতিউর সম্পর্কে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, 'মতিউর একজন আদর্শ কৃষক। কৃষিতে দরকার ধৈর্য, সেটা মতিউরের আছে। কৃষি বিভাগও সব সময় তাকে সাপোর্ট করে গেছে। কৃষক মতিউর বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের উপ-পরিচালক কনট্রাক্ট গ্রোয়ার্স (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু জাফর মো. নিয়ামতউলস্নাহ বলেন, 'মতিউর রহমান একজন পদকপ্রাপ্ত কৃষক। দিনাজপুর কনট্রাক্ট গ্রোয়ার্সের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বীজ সরবররাহকারী। তিনি বরাবরই যে বীজগুলো সরবরাহ করেন তা মানের দিক থেকে উন্নত। এবার ব্রী-ধান ৭৫-এর বীজ উৎপাদন করেছেন। মতিউরের এক কিংবা দুই দুই ফসলি জমিগুলো তিন ফসলি করার চেষ্টা করছেন। এতে ক্রপিং ইনটেনসিটি বাড়ছে (ফসলের নিবিড়তা)। যা আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় সহায়ক হচ্ছে।