ফসলি জমির মাটি খাচ্ছে ইটভাটা!

নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক ষ ঘটছে দুর্ঘটনা

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
ফেনীর দাগনভূঞার একটি ইটভাটা -যাযাদি
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১২ এর ৬ ধারায়) অনুযায়ী, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট টিলা ও পাহাড় নিধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অন্যদিকে ১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত ২০০১) অনুযায়ী, কৃষিজমির টপ সয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করাও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। দুই আইনে শাস্তির বিধান একই রকম। এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিদের দুই লাখ টাকার জরিমানা ও দুই বছরের কারাদন্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। একই কাজ দ্বিতীয়বার করলে দায়ী ব্যক্তির ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও ১০ বছরের কারাদন্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এ কাজের সঙ্গে জড়িত জমি ও ইটভাটার মালিক উভয়ের জন্যই সমান শাস্তি রয়েছে। এর পরেও থেমে নেই ফসলি জমির মাটি কাটার মহোৎসব। আর এ সব মাটি বহনকারী গাড়ির কারণে নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক। একই সঙ্গে এ সব বেপরোয়া গাড়ির চাপায় প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জড়িতদের জেল-জরিমানা অব্যাহত রংেয়ছে। এরপরও থামছে না মাটিখেকোদের দৌরাত্ব। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট- নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, নবীগঞ্জ উপজেলায় পরিবেশ আইন অমান্য করে অর্ধশতাধিক স্থানে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে বিক্রি করছে একাধিক চক্র। দিনে-রাতে জমি হতে কেটে নেওয়া মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার জায়গা, সরবরাহ করা হচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। এতে জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যও হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশ আইন অনুযায়ী কৃষিজমির মাটি কাটা দন্ডনীয় অপরাধ হলেও প্রশাসনের নিরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে। অন্যদিকে নবীগঞ্জ শহরের ভেতরের সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক দিয়ে মাটি বোঝাই ট্রাক্টর ও ডাম্প ট্রাক চলাচলের ফলে সড়কগুলো বেহাল অবস্থায় পরিণত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বেপরোয়া গতিতে মাটি বুঝাই ট্রাক্টর ও ডাম্প ট্রাকের চলাচলের ফলে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারীসহ সাধারণ মানুষ। এছাড়া নবীগঞ্জ শহরে ধুলোবালির কারণে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। পথচারীসহ ব্যবসায়ীদের নাকে রুমাল ও মাস্ক পরিধান করে চলাচল করতে দেখা যায়। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়- নবীগঞ্জ পৌরসভার তিমিরপুর, কানাইপুর, গয়াহরি, গোজাখাইর, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন এলাকা, সালামতপুর, করগাঁও ইউনিয়নের জৈন্তরী, মিলিস্নক, আউশকান্দি ইউনিয়নের সৈয়দপুর, পারকুল, কুর্শি ইউনিয়নের রাইয়াপুর, বাজকাশারা, হৈবতপুর, সুলতানপুর, রতনপুর, কুর্শি, ফুটারমাটি দেবপাড়া ইউনিয়নের আইনগাঁও, রুস্তমপুর, বাশডর, ভরাকোনো বাউসা, রিফাতপুর, গজনাইপুর ইউনিয়নের সাতাইহাল, শতক পানিউমদা ইউনিয়নের খাগাউড়া, কালিযারভাঙ্গা ইউনিয়নের মান্দারকান্দি, চানপুর, খরিয়া,ইমামবাড়িসহ অর্ধশতাধিক স্থান থেকে কৃষিজমিতে এক্সভেটর মেশিন দিয়ে মাটি কেটে সরবরাহ হচ্ছে নিকটবর্তী ইটভাটায়। বিভিন্নস্থানে এসব মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে জায়গা। পরিবেশ আইন অনুযায়ী কৃষিজমি ও টিলার মাটি কাটা দন্ডনীয় অপরাধ হলেও কার্যত কোনো প্রদক্ষেপ নিচ্ছেনা কর্তৃপক্ষ। এদিকে ট্রাক্টরের অসহনীয় বিকট শব্দে শহরাবাসী অতিষ্ট হয়ে ওঠছেন। তাদের দাবি- দ্রম্নত প্রশাসন যেন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। শহরের থানা পয়েন্ট এলাকার আরিফুল ইসলাম নামে এক বাসিন্দার অভিযোগ- কৃষি জমি থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে রাতভর শহরের উপর দিয়ে দ্রম্নতগতির মাটি বোঝাই ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টর সালামতপুরসহ স্থানে জায়গা ভরাট করছে। রাতভর মাটির গাড়ির শব্দে ঘুমাতে অসুবিধা হয়। পৌর এলাকার ওসমানী রোডের বাসিন্দা তানভীর চৌধুরী বলেন- রাত ১১টা হলেই শুরু হয় ট্রাক্টরে বিকট শব্দ, এতে করে বাসাবাড়িতে শয্যাশায়ী রোগী ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ ফজলুল হক মনি বলেন- কৃষি জমির টপ সয়েল কেটে নেওয়ার ফলে ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়। এভাবে মাটি কাটা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনুপম দাস অনুপ বলেন- খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাবুগঞ্জ (বরিশাল) প্রতিনিধি জানান, বরিশালের বাবুগঞ্জে ঢাকনাবিহীন ট্রলি ও ট্রাকে করে চলছে মাটি পরিবহণ। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এসব যানবাহন চলাচলে নষ্ট হচ্ছে রাস্তার স্থায়িত্ব। আর খোলা যানবাহনে বহনের কারণে রাস্তার ওপর পড়ে থাকছে মাটি। এতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। গুরুত্বপূর্ণ এলজিইডি'র পাকা সড়ক ধসে পরার উপক্রম হয়েছে। উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের রাজকর গ্রামের একটি পুকুর থেকে মাটি কেটে অসংখ্য ট্রলি ও ট্রাকে করে আলী মিয়ার ইট ভাটাসহ বিভিন্ন ইটভাটায় মাটি দিচ্ছে আল আমিন নামক এক যুবক। এতে সড়কে জমছে মাটির আস্তরণ। ধুলা উড়ে পথচারীসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালক, যাত্রীরা পড়ছেন দুর্ভোগে। সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের রাজকর গ্রামে (পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাবুগঞ্জস্থ ক্যাম্পাস ভেটেরিনারি অনুষদের পেছনে) পুকুর থেকে ইট ভাটায় মাটি বিক্রি করছেন আল আমিনসহ কয়েকজন। ভেকু দিয়ে ওই পুকুর মাটি কাঁটায় হুমকির কবলে রয়েছে এলজিইডি'র জনগুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো। এছাড়া গত ৫ দিন ধরে দিন-রাত হেভিওয়েট ট্রাক দ্বারা মাটি পরিবহণ করায় পুকুর থেকে রহমতপুর ইউনিয়নের রাজগুরু হতে চাঁদপাশা ইউনিয়নের ডিক্রিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক পর্যন্ত রাস্তার বেহাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও রাস্তা ভেঙে পড়ছে কোথাও সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দের। এছাড়াও দুইটি কালভার্ট ভেঙে পড়ছে। স্থানীয়রা বাঁধা দিলেও শুনছেন না তারা। স্থানীয়রা জানায়, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ওই মাটি চড়াদামে বিক্রি করছেন। রাস্তার সঙ্গে বাড়ি হওয়ায় ছোট শিশুদের নিয়ে তারা সবসময় ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এ ছাড়া পাশেই রয়েছে একটি বিদ্যালয়। কখন বুঝি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। সেইসঙ্গে মাটি বহনে অপরিচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে তাদের বাড়িঘর। এ ছাড়া স্থানীয় হাজারো মানুষ জিম্মি হয়ে পরেছে মাটি ব্যবসায়ীদের কাছে। স্থানীয়দের প্রতিবাদ আমলে নিচ্ছে না প্রভাবশালীরা। অভিযুক্ত আল আমিন বলেন, 'আমরা মাটি ক্রয় করে নিচ্ছি। রাস্তার ভাঙা অংশে ইটভাঙা দিয়ে মেরামত করে দিচ্ছি।' ইউএনও ফারুক আহমেদ বলেন, জনগনের দূর্ভোগ হয় এমন কাজ করলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দাগনভূঞা (ফেনী) প্রতিনিধি জানান, ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার ইটভাটাগুলোতে রাতের আঁধারে যাচ্ছে কৃষি জমির মাটি। কৃষি জমির মাটি বিক্রি ও ইটভাটার উপর বিভিন্ন নিয়মকানুন থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। উপজেলা প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে মাটি বিক্রি করছেন মাটি খেকোরা। এ নিয়ে চলছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ও জরিমানা। বন্যা পরবর্তীতে কৃষি বিভাগ কৃষি চাষাবাদ ও খাদ্য সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রান্তিক কৃষকদের দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রণোদনাসহ সার বীজ কীটনাশক। এমন পরিস্থিতিতে কিছু মাটি খেকো নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন উপায়ে জমির মাটি বিক্রি করছেন ভাটাগুলোতে। এতে ধ্বংসের পথে যাচ্ছে কৃষি জমিসহ অসংখ্য জমির টপ সয়েল। খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কৃষি জমি রক্ষার্থে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি মনে করেন সচেতনমহল। জানা যায়, উপজেলায় মোট ২৬টি ইটভাটা রয়েছে। তারমধ্যে ৪টির পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন ছাড়পত্র ছিলো না বিধায় পরিবেশ অধিদপ্তর তিনটি বন্ধ করে দেয়। একটিকে সনদ ঠিক করতে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে ইটভাটা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাকি ২২টির পরিবেশ অধিদপ্তরের সনদ নবায়ন হালনাগাদ করার তাগিদ দেওয়া হয়। বর্তমানে ভাটাগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়ার পর টনক নড়ে ভাটা মালিকদের। ইতিমধ্যে অনেকেই কোটি কোটি টাকা লোকশানের কথা চিন্তা করে তোড়জোড় শুরু করেছেন। ভাটার মালিকরা সরাসরি মাটি না কিনে মাটি বিক্রেতার কাছ থেকে কেনেন। তারা সরাসরি ভাটায় মাটি পৌঁছে দিয়ে টাকা নিয়ে থাকেন। এভাবে চলতে থাকলে কৃষি জমি ও বিশাল পরিমান জমির টপসয়েল ধ্বংস হতে বেশি সময় লাগবে না। অপরদিকে কয়েকটি ইট ভাটার চুলিস্নর নির্দিষ্ট উচ্চতা রাখার কথা থাকলেও তা মানেনি অনেকে। এতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ভাটার মালিকরা বলছেন কৃষি জমির মাটি ছাড়া ইট বানানো সম্ভব নয়। অন্যগুলোতে বালি তাই জমির মাটির ইটের রং সুন্দর হয়। কোটি কোটি টাকা পুঁজি দিয়ে মাটি না কিনতে পারলে ইটের দাম বৃদ্ধিসহ লোকশানের ঝুঁকিতে পড়তে হবে ভাটা মালিকদের। ইট ক্রেতা সবুজ জানান, গত বছর এক নাম্বার ইট সাড়ে ১২ হাজার টাকায় কিনতে হয়েছে। এবারও কমেনি। তারা বলছে কয়লার দাম বৃদ্ধির কারণে ইটের মূল্য বাড়ছে। আবার মালিক সমিতি একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে রেখেছে। দাগনভূঞা সহকারি কমিশনার (ভূমি) শাহিদুল আলম জানান, মাটিকাটার বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এ পর্যন্ত ৬টি মামলায় ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনেকগুলো এস্কেভেটর নষ্ট, ৫টি মাটি ভর্তি ট্রাক জব্দ করা হয়েছে।