ফের বইতে শুরু করেছে শৈত্যপ্রবাহ, কমছে তাপমাত্রা
স্বদেশ ডেস্ক দেশের বিভিন্ন স্থানে আবারো শুরু হয়েছে শৈতপ্রবাহ। টানা দুইদিন ধরে চলা শৈতপ্রবাহে ক্রমশই কমছে তাপমাত্রা। সারাদিন দেখা মিলছে না সুর্যের। দুপুরের দিকে সুর্যের আলো উঁকি দিলেও সেই আলোতে তাপ নেই। এমন তীব্র শীত ও হিমেল হাওয়ায় জবুথবু সাধারণ মানুষ। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট- রংপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, রংপুরে হাড়কাঁপানো শীত আর হিমেল হাওয়ার কাবু সাধারণ মানুষ। দুদিন ধরে সূর্যের আলো দেখা যায়নি। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ঘন কুয়াশা অব্যাহত থাকায় দুপুর পর্যন্ত হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। প্রচন্ড শীতে জনজীবন জবুথবু হয়ে পড়েছে। রংপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। এর আগের দিন এ জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের এ তীব্রতা আরও দু-এক দিন অব্যাহত থাকতে পারে। রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত দুই দিনে এই হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ছয় শিশু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। তাদের মধ্যে ৩ জন ৮ থেকে ১০ দিন বয়সী সদ্যপ্রসূত শিশু। আক্রান্ত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছে দেড় শতাধিক শিশু। এদিকে, রংপুর জেলার জনসংখ্যা প্রায় ত্রিশ লক্ষাধিক, এর মধ্যে শীতার্ত মানুষের সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে শুধু রংপুর নগরীতেই বাস করেন প্রায় ৭০ হাজার ভাসমান নারী-পুরুষ। এরা রেলস্টেশনের পস্ন্যাটফর্ম, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতের বারান্দা আর ফুটপাতে রাত কাটান। জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। একইভাবে জেলার আট উপজেলা বিশেষ করে তিস্তা, ঘাঘট, করতোয়া, যমুনেশ্বরী বিধৌত চরাঞ্চলে বসবাসকারী হাজার হাজার পরিবার শীতে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। তাদের বেশিরভাগ মানুষের কাছে এখনো শীতবস্ত্র পৌঁছেনি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল জানান, শীতের শুরুতেই ৩১ হাজার ৫০০ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে এবং আরও কম্বল বিতরণের কাজ চলছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানিয়েছেন, মাঘ মাসের শুরুতে শীতের তীব্রতা পঞ্চগড় ও দিনাজপুরে বেশি ছিল। বর্তমানে রংপুর বিভাগে শীতের তীব্রতা কমতে শুরু করেছে। আগামী ৪ থেকে ৫ দিন ধরে শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, গত ৩দিন ধরে ঘন কুয়াশা ও শীতের তীব্রতায় কুড়িগ্রামের রাজারহাটের মানুষ চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত দু'দিন ধরে সূর্যের দেখা মেলেনি। তবে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে সূর্যের মুখ দেখা গেলেও কিছুক্ষণ পর ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। শির শির হিমেল হাওয়ায় কাজে বের হওয়া মানুষগুলো পড়েছে চরম বিপাকে। হঠাৎ করে ঠান্ডা নেমে আসায় মানুষ কাহিল হয়ে পড়েছে। নিরুপায় হয়ে মানুষজন গরম কাপড়ের দোকানগুলোতে ভীড় করছে। শিশু-বৃদ্ধরা সর্দি কাশি, জ্বর ও শীত জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে বলে রাজারহাট স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স সূত্র জানিয়েছে। তবে ঠান্ডায় কেউ মারা যায়নি বলে হাসপাতালের আরএমও ডা. বিউটি বেগম নিশ্চত করেছেন। উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চর বিদ্যানন্দ নামাপারার বাসিন্দা বানু মামুদ (৬৫) বলেন, 'মুই মানুষের কাম করি খাং। এবার এতো জাড়, গাও পাও জারতে ঠর ঠর করি কাঁপছে। মুই জাড়ের জন্যে আলু তুলবারও যাং নাই। তিস্তা নদীর হালাউ হালাউ বাতাসে ঘর থাকি বাইরে বেরা যায় না বাহে।' রাজারহাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, এবারে ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে প্রায় ৫হাজার ৪শ' কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, বৃহস্পতিবার রাজারহাট উপজেলায় ১২ দশমিক ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। গত বুধবার রাজারহাটের তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগামী ২৪ঘন্টায় তাপমাত্রা আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনেরাতে হিমশীতল বাতাসের কারণে উপজেলায় শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে ঘন কুয়াশায় দিনের বেলাও হেড লাইট জ্বালিয়ে ধীর গতিতে চলাচল করছে ছোট বড় যানবাহন। দিনাজপুর আবহাওয়া কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, গত বুধবার দিনাজপুরে সকাল ৬টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আদ্রতা ছিল ৯২% এবং গত ২৪ ঘন্টায় বাতাসের গড় গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৩ কিলোমিটার। এছাড়া দিনাজপুরের আশপাশ কয়েকটি জেলার সকাল ৬টার তাপমাত্রা: তেতুলিয়া (পঞ্চগড়): ১১.৫, রংপুর: ১৩.০ ডিগ্রি। ফুলবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কনকনে হাঁড় কাপানো শীত আর ঘন কুয়াশার কারণে প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সড়কগুলো যানবাহন চলাচল করলেও কুয়াশার কারণে হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরগতিতে চলছে। মানুষজন কম থাকায় পৌরশহরের সড়কগুলোতে রিকশা-ভ্যানে যাত্রী শূন্যতা দেখা গেছে। পরিবারের চাহিদা মেটাতে শীত আর কুয়াশাকে উপেক্ষা করেই কাজের সন্ধানে ছুটছেন দিনমজুর আর ক্ষেতমজুররা। বুধ ও বৃহস্পতিবার সারাদিনে ফুলবাড়ীতে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। গরম কাপড়ের অভাবে শীতে কাহিল হয়ে পড়েছেন হতদরিদ্র পরিবারগুলো। শীতের কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে শ্বাসকষ্টসহ শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা বেশি। পৌরশহরের রিকশাভ্যান চালক মনোয়ার হোসেন বলেন, কনকনে শীতের জন্য রিকশা নিয়ে বাইরে যেতে মন চায় না। তাছাড়া সকালে লোকজনও কম থাকছে। এজন্য আয়ও কমে গেছে। শীতের কারণে দিন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হচ্ছে। অন্য সময় গড়ে দিনে ৫০০ থেকে ৭০ টাকা আয় হয়ে থাকে। ক্ষেতমজুর বছির মিয়া বলেন, এ সময় ক্ষেতে খুব ঠান্ডা লাগে, এ জন্য সকালে ক্ষেতে যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু কাজ না করলে পরিবারের মুখে খাবার জুটবে না, এজন্য শীত আর কুয়াশার মধ্যেই কাজে যেতে হচ্ছে। উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের পশ্চিম জানিপুর গ্রামের কৃষক শাহিনুর রহমান বলেন, বাঁধাকপি লাগিয়েছেন এক বিঘা জমিতে তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশার কারণে সকালে ক্ষেত থেকে বাঁধাকপি তুলে বিক্রির জন্য বাজারে আনা যাচ্ছে না। এতে করে ক্ষেতের বাঁধাকপি বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মো. আল কামাহ তমাল বলেন, উপজেলার দুস্থ শীতার্তদের জন্য ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রথম পর্যায়ে ২০০ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৮৭০টি কম্বল এবং নগদ ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। নগদ ৩ লাখ টাকা দিয়ে আরও ৯১০ কম্বল কেনা হয়েছে। ইতোমধ্যেই কম্বলগুলো উপজেলার এতিমখানাসহ, ছিন্নমূল মানুষ ও দুস্থদের বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স সূত্রে জানা গেছে, শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি। কয়েক দিন ধরে তীব্র শীতের কারণে শিশুদের নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। শিশুদের যাতে শীত না লাগে এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) প্রতিনিধি জানান, সূর্যের দেখা নেই সারাদিন। প্রচন্ড ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে তীব্র শীত আর হিমেল হাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দামুড়হুদা উপজেলার জনজীবন। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে অসহায় দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ। সড়কে পরিবহন হেড লাইট জালিয়ে চলাচল করছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টায় চুয়াডাঙ্গায় ১২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৭ শতাংশ। তীব্র শীত উপেক্ষা করে কাজের সন্ধানে ছুটছে খেটে খাওয়া মানুষ। আগামী ২৬ জানুয়ারি থেকে তাপমাত্রা আরও কমার সম্ভাবনা জানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রকিবুল হাসান। তিনি জানান, আগামী ২৬ জানুয়ারি থেকে তাপমাত্র ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ৩-৪ দিন জেলার উপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। উপজেলা সদরের দশমী পাড়ার হাবিবুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত ঠান্ডা আর কুয়াশার কারনে ছোটদের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। ভ্যানচালক ঝন্টু মিয়া জানান, সকালে ভ্যান নিয়ে বের হওয়া যাচ্ছে না। কোন মতে বের হলেও রোডে মানুষ চলাচল খুবই কম। কোন যাত্রী হচ্ছে না। দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হেলেনা আক্তার নিপা বলেন, জেলার উপর দিয়ে শৈতপ্রবাহ চলছে। এতে শিশুরা নানা ধরনের ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত যাতে না হয় সে জন্য নিজেদের সচেতন হতে হবে। ছোটদের সকালে রোদ বের না হওয়া পর্যন্ত ঘর থেকে বের হতে দেওয়া যাবে না। তাদের কুসুম গরম পানিতে গোসল করাতে হবে।
প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
